সারাদেশে পানি বন্দি আছে কয়েক লাখ মানুষ

সারাদেশঃ
দেশের বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় নদ-নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কোথাও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় এখনো পানিবন্দি আছে কয়েক লাখ মানুষ।

কুড়িগ্রাম: জেলার ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ সবকয়টি নদ-নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে জেলার নয় উপজেলার চার শতাধিক চর ও দ্বীপচরসহ নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকার দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩০ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৪৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৭৯ সেন্টিমিটার, তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ২২ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ৪৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৩৯ সেন্টিমিটার এবং চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৪৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। লোকজন আশ্রয় নিতে শুরু করেছে পার্শ্ববর্তী উঁচু বাঁধ, পাকা সড়ক ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব এলাকার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসন থেকে ২৮০ টন জিআর চাল, দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গতকাল (১৪ জুলাই) থেকে এসব ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। এছাড়া নতুন করে এক হাজার টন চাল, ২০ লাখ টাকা ও ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলার সব সরকারি দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গোড্ডিমারী ইউনিয়নের তিস্তা ব্যারাজের উজানে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপত্সীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশীদ বলেন, বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এ কারণে আবারো বাড়ছে তিস্তা নদীর পানি। পানিপ্রবাহ বিপত্সীমার নিচে এখনই নামবে কিনা, তা বলা যাচ্ছে না।

এদিকে ভেতরে পানি ঢুকে পড়ার কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৪৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। লালমনিরহাট প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লালমনিরহাট সদর উপজেলায় ১৬টি, আদিতমারী উপজেলায় আটটি, কালীগঞ্জ উপজেলায় দুটি ও হাতীবান্ধা উপজেলায় ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় সাময়িকভাবে শ্রেণী পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় লালমনিরহাট সদর উপজেলায় চারটি, আদিতমারী উপজেলায় একটি, কালীগঞ্জ উপজেলায় একটি, হাতীবান্ধা উপজেলায় পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পাটগ্রাম উপজেলায় একটি দাখিল মাদ্রাসার শ্রেণী পাঠদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে এসব বিদ্যালয়ে শ্রেণী পাঠদান পুষিয়ে নিতে বিশেষ শ্রেণী পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে।

নেত্রকোনা : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ের ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় জেলার সোমেশ্বরী, উব্দাখালি ও কংস নদীর পানি বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে জেলার পূর্বধলা, আটপাড়া ও মোহনগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে নতুন করে পানি ঢুকছে। প্রায় ২০০ হেক্টর জমির আউশ ফসল, আমন বীজতলা ও সবজির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বন্যার্তরা জানিয়েছেন, ২০টি ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক গ্রামে পানি ঢুকেছে। এসব গ্রামে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছে। তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচ-ছয় শতাধিক পরিবারের ঘরের ভেতরে পানি ঢুকেছে। তারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। অনেক এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ এখনো না পৌঁছার অভিযোগ করেছেন বন্যার্তরা।

বগুড়া: জেলায় যমুনা নদীর পানি গতকাল দুপুর পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় ২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট ও সোনাতলা উপজেলার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, বন্যায় তিন উপজেলায় ৫৬৮ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল এবং ৮০টি গ্রামের প্রায় ৫৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উজান থেকে আসা ঢলে বগুড়ায় যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্বদিকের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে গতকাল দুপুরে যমুনার পানি বিপত্সীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ৮০টি গ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে ৫৬৮ হেক্টর কৃষি জমি। এছাড়া ধুনট উপজেলার আরো কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। সেখানেও প্রায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।

রংপুর: জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি গতকাল সকাল ৯টার দিকে বিপত্সীমার ১ দশমিক ১২ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর ফলে গংগাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকা এবং চরাঞ্চলের গ্রামগুলোয় ১৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

সিলেট: টানা বৃদ্ধির পর অবশেষে কমতে শুরু করেছে সুরমা নদীর পানি। গতকাল সিলেটের সবকয়টি পয়েন্টেই সুরমার পানি কমেছে। তবে এখনো বিপত্সীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে সুরমার পানি। অপরদিকে, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে কুশিয়ারা নদীতে।

সুরমার পানি কমলেও প্লাবিত এলাকাগুলো এখনো নিমজ্জিত আছে। ফলে এখনো পানিবন্দি অবস্থায় আছে জেলার পাঁচ উপজেলার দুই লক্ষাধিক লোক।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর অমলসীদ পয়েন্টে বিপত্সীমার ১ দশমিক ৩ মিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে, যা আগের দিন একই সময়ে ১ দশমিক ৫৯ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। অন্যদিকে সিলেট পয়েন্টে গতকাল সন্ধ্যায় বিপত্সীমার দশমিক ৬ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় সুরমা নদীর পানি।

গতকাল দিনভর বৃষ্টি ছিল সিলেটে। তবে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এতে নিম্নাঞ্চলে বন্যার পাশাপাশি নগরীর কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতাও দেখা দিয়েছে। সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার বেশকিছু এলাকা বন্যাক্রান্ত হয়েছে। এসব উপজেলা আঞ্চলিক অনেক সড়ক এখনো পানির নিচে। বন্ধ রয়েছে শতাধিক স্কুলে পাঠদান। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় দুর্ভোগ বাড়ছে পানিবন্দি মানুষদের। রোববার প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়।

সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপত্সীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বৃষ্টি কমে যাওয়ায় নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে পাঁচ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের বাড়িঘর ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো পানির নিচে রয়েছে।

গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন, বন্যার পানি ধীরগতিতে কমছে। বৃষ্টি হলেই পানি বেড়ে যাচ্ছে। তবে আগের তুলনায় বৃষ্টিপাত অনেক কমে গেছে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে বেশকিছু দিন সময় লাগবে। শনিবার থেকে রোববার পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি ৪ সেন্টিমিটার কমেছে।

-কেএম

FacebookTwitter