বিশেষ প্রতিবেদনঃ
বৃহত্তর গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা অর্থাৎ যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও খুলনা জেলায় বরাবরই খেজুরগাছ জন্মে বেশি। এক সময় অর্থকরী ফসল বলতে খেজুর গুড়ের বেশ কদর ছিল। ধান উৎপাদনে জমির ব্যবহার ছিল স্বল্প। পড়ে থাকত দিগন্তজোড়া মাঠ। বনজঙ্গলে ভরা। আর সেখানে বিনা রোপণ ও বিনা পরিচর্যায় বুনোলতার সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়ে উঠত খেজুরগাছ। তা থেকে রস বের করে তৈরি হতো উৎকৃষ্ট গুড়।
এ ছাড়াও বাংলার সব জেলাতেই খেজুর গাছ দেখা যায়। খেজুর গাছ মানেই শুধু খেজুর না। এ থেকে শীত কালের আকর্ষণ খেজুরের টাটকা রস বহুল পরিচিত। উত্তর বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ সবজেলাতে এই খেজুর রসের আকর্ষণে বছরে একবার গ্রামের বাড়িতে যেতেই হবে। টাটকা রসের সাথে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়ার প্রচলনে উত্তরবঙ্গের নওগাঁর ঘরে ঘরে চলে উৎসব। এ ছাড়া জামাই আদরের জন্য খেজুরের রসের পায়েশ, সন্দেশ অনন্য।
প্রবাদে প্রচলিত যশোরের খ্যাতি খেজুরের রস। যশোরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। খেজুরের রস নিয়ে বহু কবি কত শত কবিতা রচনা করেছেন। একটি কবিতার বর্ণনায় কয়েকটি লাইন ছিল এরকম- শীত এসেছে আমার বাড়ি/ নিয়ে একটা রসের হাঁড়ি, শীত এসেছে আমার দেশে/ দেশটাকে ভাই ভালোবেসে, শীত এসেছে পিঠা নিয়ে/ খেজুরের রস মিঠা নিয়ে…..।
ব্রিটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকেই তৈরি হতো চিনি। এ চিনি ‘ব্রাউন সুগার’ নামে পরিচিত ছিল। খেজুরের রস থেকে উন্নতমানের মদও তৈরি করা হতো। এই চিনি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো। বিলেত থেকে সাহেবরা দলে দলে যশোর অঞ্চলে এসে চিনির কারখানা স্থাপন করে চিনির ব্যবসায় নামেন। সে সময় চিনির কারখানাগুলো চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুর শহরের আশপাশে কেন্দ্রীভূত ছিল।
যশোরের খেজুরের রস ও গুড় স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। যশোরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলের চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুরের আশপাশে প্রায় ৫০০ চিনি কারখানা গড়ে উঠেছিল। তখন কলকাতা বন্দর দিয়ে খেজুর গুড় থেকে উৎপাদিত চিনি রপ্তানি করা হতো। মূলত ১৮৯০ সালের দিকে আখ থেকে সাদা চিনি উৎপাদন শুরু হলে খেজুর গুড় থেকে চিনির উৎপাদনে ধস নামে। একে একে কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। খেজুরের গুড় থেকে চিনি তৈরি না হলেও এখন পর্যন্ত বাঙালির কাছে খেজুর গুড় পাটালির কদর কমেনি। তবে বিজ্ঞানের এই যুগে এখনো রস থেকে গুড় পাটালি তৈরিতে মান্ধাতা আমলের পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। গুড় পাটালি তৈরিতে আধুনিকতা আনা গেলে এটিও রপ্তানি পণ্যের তালিকায় স্থান পেত।
শীতে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ কাটেন গাছিরা। খেজুরগাছ থেকে রস বের করার উপযোগী করে কাটা শুরু হয় হেমন্তের প্রথমেই। প্রথম গাছ কাটার পর দ্বিতীয়বার চাঁছ দিয়ে সেখানে বসানো হয় কঞ্চির বিশেষভাবে তৈরি নল। তার পাশে বাঁশের তৈরি ছোট শলাকা পোঁতা হয় ভাঁড় (কলস) টাঙানোর জন্য। সারারাত চোখ বেয়ে নল দিয়ে রস পড়ে ভাঁড়ে।
খেজুরগাছ কাটা ও তা থেকে রস বের করার মধ্যেও কিছু কৌশল আছে। যে কেউ ভালো করে গাছ কাটতে কিংবা রস বের করতে পারেন না।
কখন, কিভাবে, কোনখানে কেমন করে কাটতে হবে এবং যার ফলে গাছ মারা যাবে না, অথচ বেশি রস পাওয়া যাবে তা একজন দক্ষ গাছিই ভালোই জানেন।
একবার গাছকাটার পর ২-৩ দিন পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। প্রথম দিনের রসকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় জিরেন। এ জিরেন রস স্বাদে ও মানে অনন্য। জিরেন রস দিয়ে তৈরি হয় উন্নত মানের গুড় ও পাটালি। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলা হয় দোকাট এবং তৃতীয় দিনের রসকে বলা হয় তেকাট ওলা। যা দিয়ে তৈরি হয় ঝোল গুড়।
রসের জন্য একবার কাটার পর ৫-৬ দিন বিরাম থাকে কাটা জায়গা শুকানোর জন্য। শুকিয়ে গেলে আবার রস সংগ্রহ চলে। এ সময় সুমিষ্ট, সুগন্ধে মৌ মৌ চারদিক। এর সুবাস আর স্বাদে ভিড় জমাতে থাকে পিঁপড়া, মৌমাছি, পাখি ও কাঠবিড়ালি।
এ অঞ্চলের মানুষ রস ও গুড় দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের পিঠা, পায়েস। বানানো হয় নানা ধরনের পাটালি। তাই গাছ শুকানোর জন্য বছরে বছরে ঘুরিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে কাটা অংশে। তাই যশোর এলাকায় দক্ষ গাছির কদর বরাবরই বেশি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শীত এলেই গাছিরা গাছ পরিষ্কার ও রস জ্বাল করার জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।
শোনা যায়, আগেকার দিনে শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য এলাকা থেকে যশোরে আসতেন গাছিরা। কারণ, যশোর এলাকার মানুষ অতীতে অলস ছিল। সেই গাছিরা গাছ তুলতেন, কাটতেন, রস বের করে গুড় বানাতেন। শীতের শেষে ফাল্গুনের সময় পারিশ্রমিক নিয়ে ফিরে যেতেন নিজেদের এলাকায়। এসব গাছিরা ছিলেন মূলত পেশাদার। কার্তিক থেকে ফাল্গু- এ ৫ মাস তারা যুক্ত থাকতেন গাছ কাটার কাজে। এখন দিন বদলেছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের দরুন যশোর এলাকার মানুষও শিখে নিয়েছে গাছ কাটা। গ্রামাঞ্চলের প্রায় পরিবারেই আছেন গাছি, নিজ মালিকানায় আছে কিছু না কিছু খেজুরগাছ। এখন পেশাদার গাছিদের তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না।
‘গাঁওগেরামের’ অভাবের সংসারও রস, গুড়, পিঠা ও পায়েসের ম-ম গন্ধে ভরে যায়।
গত শতাব্দীতে শুধু গুড় বেচাকেনার জন্যই যশোরের বিভিন্ন নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য বাজার। নদীর পাটা শেওলা ব্যবহার করে তৈরি করা হতো হাজার হাজার মণ চিনি। যা রপ্তানি করা হতো ইউরোপের দেশে। সে সময় গাছিদের কদর ছিল দারুণ। খেজুরগাছ কাটা মৌসুমে খেজুর বাগানেই বাঁধা হতো ছোট কুঁড়েঘর। সেখানেই চলত গাছিদের খাওয়া-দাওয়া, রাত্রিযাপন। খেজুরগাছ কাটা শুরু হতো দুপুরের পর থেকেই।
ভোর থেকে রসের ভাঁড় নামিয়ে তা বাইন বা চুলায় চড়িয়ে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হতো। ৫ মাস গাছিরা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটাতেন। রাতে অবসর বিনোদনের জন্য কুঁড়েঘরের পাশে আগুন জ্বালিয়ে বসত কবিগানের আসর।
গাছিদের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ নিয়ে পুথি-সাহিত্যেও কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন একটি পুথি-সাহিত্য ছিল এমন- ঘরেতে বধূয়া কান্দে ফিরে নাহি চাও /গাছি ভাই গাছ কাটতে দূর দেশে যাও- গুড় মিঠা, রস মিঠা, মিঠা গাছির মন/ সব বোঝে, বোঝেনাতো কুমারীর মন।
দূর গাঁয়ে বিরহী বধূর দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রয়োজনও এখন আর নেই। ফলে, গাছিদের জীবনের প্রতিচ্ছবিও অনুপস্থিত গল্প কবিতায়। তবুও গাছিরা আছেন। শীত পড়লেই দিন শেষে বাঁকবোঝাই ভাঁড় নিয়ে তারা ছোটেন খেজুর বাগানে। ধারালো দায়ের কোপে বৃক্ষের বুক বিদীর্ণ করে বের করে আনেন মিঠা রস। দেশে খেজুরের কোনো উন্নত জাত নেই। এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণাও কোনো দিন হয়নি। ইরাক, ইরান ও সৌদি আরবে যে উন্নত জাতের খেজুরগাছ জন্মে, তা কেবল খেজুর উৎপাদনেই সক্ষম। তবে ‘শুষ্ক কাস্ট’ এ রকম একটি বৃক্ষ থেকে সুমিষ্ট রসও বের করে আনা যায়। এ গবেষণা এ অঞ্চলে কে, কবে, কোথায় করেছিল তা জানা যায় না। খেজুরগাছের বয়স ৫-৬ বছর হলে তা থেকে রস সংগ্রহ করা যায় এবং ২৫-৩০ বছর ধরে রস সংগ্রহ করা চলে। তবে মাঝবয়সী গাছে রস বেশি পাওয়া যায়। আবার দোআঁশ ও পলিমাটিতে জন্মানো গাছ থেকে বেশি রস হয়।
তবে বৃক্ষনিধনকারীদের নজর পড়েছে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই, তাই তারা উচ্চমূল্য দিয়ে ইটভাটার জন্য কিনছে খেজুরগাছ। অন্য অর্থকরী ফসল চাষাবাদের জন্য খেজুরগাছের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমে গেছে। তবুও এখনো খেজুরের গুড় উৎপাদনে বৃহত্তর যশোর শীর্ষে।
-ডেআর