অনলাইনঃ
নগর জীবনে স্বাস্থ্যঝুঁকির একটি অন্যতম কারণ হলো শব্দদূষণ। নির্মাণকাজ, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এতে একদিকে জনগণ যেমন শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে রয়েছেন সেই সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শব্দদূষণ দুশ্চিন্তা, অবসাদ, উদ্বিগ্নতা, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি বাড়িয়ে দেয়। যা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এ আবাসিক, নীরব, মিশ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক মোট পাঁচ ধরণের এলাকা এবং সেখানে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও বাস্তবে সকল স্থানেই শব্দের মাত্রা মাত্রাতিরিক্ত।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সকল শ্রেণী- পেশার মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক সংগঠন এবং বেসরকারি সংগঠনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। নিজস্ব কাজের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলো যদি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাহলে সমাজে কার্যকর প্রভাব পড়বে।
এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আজ ০৮ জুন ২০২১ পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রনে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প এর আওতায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) প্রতিনিধিগণের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক জনাব মো হুমায়ুন কবীর (যুগ্ম সচিব)। তিনি বলেন, আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই শব্দদূষন নিয়ন্ত্রণে সফলতা আনা সম্ভব। মাটি, পানি, বায়ু দূষণের পাশাপাশি শব্দদূষণের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২০-২০২২ মেয়াদে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রনে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী, শব্দের সহনশীল মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া হলেও আমরা তা অনুসরণ করতে পারছি না। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্যে বেসরকারি সংস্থাসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
আয়োজনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা। তিনি বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি সংস্থাসমূহ বিভিন্ন ভূমিকা রাখতে পারেন। যেমন- পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার্থে সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে (যেমন বিশ্ব পরিবেশ দিবস, আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস, বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস ইত্যাদি) নিয়মিত কার্যকর অংশগ্রহণ এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন আয়োজন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ, নীরব ও আবাসিক এলাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শব্দদূষণ বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা ইত্যাদি।
বিশেষ অতিথি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মেখলা সরকার বলেন, শব্দদূষণের ফলে শবণক্ষমতা নষ্ট হয় তা আমরা সবাই জানি।
কিন্তু এর মানসিক প্রভাব নিয়ে আমরা যথেস্ট সচেতন নই। শব্দদূষণের ফলে মানুষের মধ্যে উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়। যা ধীরে ধীরে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা তৈরি করে।
৩০ টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ হলো শব্দদূষণ। আমাদের পরিবেশের উপরও শব্দদূষণের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আমরা যদি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক বড় ঝুঁকি তৈরি হবে।
বিশেষ অতিথি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের প্রধান প্রফেসর শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমি বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শব্দদূষণের কারণে অনেক বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে।
অতিরিক্ত হেডফোনের ব্যবহার, গাড়ির অনাকাঙ্খিত হর্ন, নির্মাণকাজের শব্দ ইত্যাদি তাদের ধীরে ধীরে বধিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের প্রচারণার ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। টেলিভিশনে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। সেই সাথে পাঠ্যপুস্তকেও শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব মো সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৯.৬ শতাংশ মানুষ শ্রবণ প্রতিবন্ধিতার শিকার। একজন গর্ভবতী মা যদি শব্দদূষণের মধ্যে থাকেন তাহলে তার শিশুর অটিজম বা যেকোন ধরণের প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে সেক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।
প্রধান অতিথি এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জনাব মো শাহাদাৎ হোসাইন পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক চলমান প্রকল্পের প্রশংসা করে সর্বস্তরে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন জনবহুল ও ব্যস্ত রাস্তায় বিলবোর্ড স্থাপন এবং সচেতনতামূলক ভিডিও প্রদর্শনীর পরামর্শ দেন। তিনি এনজিওদের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রকল্প গ্রহণেরও পরামর্শ দেন।
এ ক্ষেত্রে তিনি যেহেতু পরিবেশ অধিদপ্তর সকল ধরনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সেহেতু শব্দদূষণে গৃহিত যে কোন প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটিসহ পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক মনিটরিং করতে হবে মর্মে মতামত দেন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সফলতা আসলে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনেও অনেকটা এগিয়ে যাবো।
সভাপতির বক্তব্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জনাব মো: আশরাফউদ্দিন বলেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইন প্রয়োগেও সচেষ্ট হতে হবে। আমরা এ বিষয়ে দ্রুত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু করতে চাই। হাইড্রলিক হর্ন আমদানি বন্ধের জন্য আমাদের কাস্টমস্- এর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থাসমূহ যদি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে তাহলে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে।
আয়োজনে বেসরকারি সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিগণ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন, যেমন- তৃণমূল পর্যায়ে শব্দদূষণ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, যুবসমাজকে এ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা, লিফলেট বিতরণ, বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ, নিয়মিত মনিটরিং, লঞ্চের ইঞ্জিনে সাইলেন্সারের ব্যবহার নিশ্চিত, মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, আবাসিক এলাকা থেকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে ফেলা, মিডিয়ায় প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের উদ্বুদ্ধ করা, নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা ইত্যাদি।
আয়োজনটিতে অংশগ্রহণ করেন ২৪ টি জেলার প্রায় ৬০ টি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহন করেন।
-শিশির