‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ উদ্বোধন; রেল উন্নয়নে বিশাল পরিকল্পনা

‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ উদ্বোধন; রেল উন্নয়নে বিশাল পরিকল্পনা
‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ উদ্বোধন; রেল উন্নয়নে বিশাল পরিকল্পনা

জাতীয়ঃ

স্বল্প ব্যয়ে আম পরিবহনের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী-ঢাকা রুটে চালু হলো ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ অপরাহ্নে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ চলাচলের উদ্বোধন করেন।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে জ্যৈষ্ঠ মাস মধুমাস হিসেবে পরিচিত এবং এ মাস বাঙালির প্রিয় ফল আম উৎসবের মাস উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ উপলক্ষে তাঁর ভাষণে বলেন, উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। আমের মৌসুমে উত্তরবঙ্গের চাষীদের উৎপাদিত আম সাশ্রয়ী ভাড়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহনের জন্য ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এতে আমচাষী ও ব্যবসায়ীগণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে এবং সহজে কৃষিপণ্য বাজারমুখী করার পথ প্রশস্থ হবে, অন্যদিকে ভোক্তাদের সুলভ মূল্যে আম ক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সুত্র জানায়, ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনে প্রতি কেজি পণ্য পরিবহনে খরচ পড়বে মাত্র ১ টাকা ১৭ পয়সা। যেখানে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতি কেজি আম পরিবহনে খরচ পড়ছে ২০ টাকার মতো।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ম্যাংগো স্পেশাল বিশেষ এই ট্রেন প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত চলাচল করবে। ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশন থেকে বিকেল সাড়ে ৪টায় ছাড়বে।

ট্রেনটি রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এবং ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছবে রাত ২টায়। আম নামিয়ে রাতেই ট্রেনটি আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যাবে।

মালামাল তোলার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আমনুরা, রহনপুর, কাঁকন, রাজশাহী, হরিয়ান, সরদাহ, আড়ানী, আবদুলপুর স্টেশনে থামবে বিশেষ এ ট্রেন। ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের পাঁচটি ওয়াগনে (পণ্যবাহী বগি) পণ্য পরিবহন করা হবে। প্রতিটি ওয়াগনে ৪০ টন করে মোট ২০০ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দরিদ্রবান্ধব পরিবহন হিসেবে মানুষের যাতায়াত এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের জন্য যেসব জায়গায় এখনও রেললাইন নেই সেসব স্থানে নেটওয়ার্ক স্থাপন করে সমগ্র বাংলাদেশকে রেল যোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য।

পাশাপাশি, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেসব স্থানের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেগুলো পুনঃস্থাপন করে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায় সরকার।

শেখ হাসিনা মধুখালী-কামারখালী হয়ে মাগুরা পর্যন্ত নতুন রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পেরও ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

তিনি আজ অপরাহ্নে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে সরকারের ব্যাপক রেলনেটওয়ার্ক স্থাপনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, খুলনা-দর্শনা ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন, সিরাজগঞ্জ-বগুড়া ডুয়েলগেজ রেললাইন, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন এবং আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ রেললাইন আমরা করছি এবং আমাদের আরো পরিকল্পনা রয়েছে সেটারও পদক্ষেপ আমরা নেব।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে লালমনিরহাট থেকে কুড়িগ্রাম হয়ে চিলমারি পর্যন্ত যোগাযোগের ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্তমানে চিলমারী বন্দরের উন্নয়ন কাজ চলছে। তিনি এ সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য রেল মন্ত্রণালয়ে প্রতি নির্দেশ দেন।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলের কাজ চলছে অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশটাকেই আমরা রেলের আওতায় নিয়ে আসছি।

তিনি বলেন, তাঁর সরকার ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ ডুয়েল গেজ রেললাইন এবং টংগী-জয়দেবপুর ডুয়েল গেজ ডাবল রেললাইন, আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ করছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলওয়ে নির্মাণ ও সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে, এখনকার মাটি কতটুকু স্পিড নিতে পারবে সেটার ফিজিবিলিটি স্টাডি করেই নির্মাণ করা হবে। সবথেকে বড় কথা আমরা যে পদ্মাসেতু নির্মাণ করছি সেখানেও রেললাইন থাকছে।

তিনি বলেন, পদ্মাসেতু পার হয়ে ভাঙ্গা হয়ে একদিকে যেমন যশোর-খুলনা পর্যন্ত যোগাযোগ করা হবে, অপরদিকে সোজা বরিশাল হয়ে একেবারে নতুন সমুদ্র বন্দর পায়রা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হবে। সেই পরিকল্পনাও সরকার নিয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বরিশাল অঞ্চলে বড় বড় নদী রয়েছে, খাল বিলে ভরপুর এই এলাকাটাকে বলা হত বাংলার ভেনিস, যেখানে ব্রিটিশ সরকার পর্যন্ত রেল স্থাপনের প্রচেষ্টা নিয়ে একদা ব্যর্থ হয়েছিল। সেই রেলপথ নির্মাণে ব্রিটিশদেরকেই অনুরোধ করা হয়েছে এবং এর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ চলছে।

রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন মাগুরা রেলস্টেশন থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। রেল সচিব সেলিম রেজা স্বাগত ভাষণ দেন।

’৯৬ সালে ২১ বছর পর সরকারে এসেই আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী ভেঙ্গে পড়া রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে উল্লেখ করে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বলেন, রেল পরিবহন, আমাদের সড়ক পরিবহন, নৌ পথ এবং আকাশ পথসহ সবগুলো পথকেই আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দেই এবং রেলওয়ের জন্য আলাদাভাবে একটা মন্ত্রণালয় করে দেই।

তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপসনে বিএনপি সরকারের রেল বন্ধের বিরুদ্ধে তাঁর সরকার জনবান্ধব এই পরিবহন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে আলাদাভাবে বাজেট করে, যেন রেল নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেজন্যই এই পদক্ষেপ ।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শক্রমে রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যার জন্য রেলের অনেক লাইন, যোগাযোগ এবং রেল ষ্টেশন বন্ধ হয়ে যায়, গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে রেলের অনেক অভিজ্ঞ লোককে তারা বিদায় দিয়ে দেয়।

পুরো রেল যোগাযোগটাকে তারা প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ক্ষমতায় এসেই বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ওপরে রেল যোগাযোগ স্থাপন করে। সেই সঙ্গে রেলকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজ তাঁরা হাতে নেন, যেভাবে জাতির পিতা দেশব্যাপী একটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যাতে করে স্বল্প খরচে যোগাযোগ এবং পণ্য পরিবহন সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যই ছিল একদিকে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন চলবে তেমনি অন্যদিকে মানুষের যাতায়াতটাও যাতে সহজ হয়। ফলে, রেলকে তাঁর সরকার গুরুত্ব দেয়।
শেখ হাসিনা বলেন, অন্যের পরামর্শ নিয়ে আমরা চলি না। বাংলাদেশটা কিভাবে চলবে, উন্নত হবে, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য কিভাবে পরিবর্তন হবে, মানুষের কিভাবে উন্নতি হবে সেটাকেই আমরা গুরুত্ব বেশি দেই। যে কারণে সমগ্র বাংলাদেশে আজকে আমরা রেল যোগাযোগের ব্যাপক কর্মসূচি আমরা হাতে নিয়েছি এবং যেসব এলাকায় রেল নাই সেখানেও রেল সংযোগ দেয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল সংযোগ প্রদানের সাফল্য দেখে যারা একসময় বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ বন্ধই করে দিয়েছিল তারাই এখন আবার উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে একটি পৃথক রেলসেতু করার। যে কারণে যমুনা নদীর ওপর ডেডিকেটেড রেল সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়েছে এবং বর্তমানে সেই কাজও এগিয়ে যাচ্ছে।
তাঁর সরকার ঢাকা-মংলা রেল যোগাযোগ স্থাপন করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় খুলনা-বাগেরহাট হয়ে মংলা পর্যন্ত রেল লাইন ছিল। কিন্তু বাগেরহাটের রেললাইনটি খালেদা জিয়ার সরকার বন্ধ করে দেয়। তবে, তাঁর সরকার নতুনভাবে এবং আরো আধুনিক করে সেই রেলপথ নির্মাণ করছে, উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

মাগুরায় রেল যোগাযোগ স্থাপন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহুদিন পর্যন্ত মাগুরাবাসীর রেলের একটা আকাঙ্খা ছিল। এখানে আগে কখনও রেল লাইন ছিল না। অথচ এর পাশ দিয়েই রেল লাইন চলে গিয়েছিল। তাই, মধুখালি-কামারখালি হয়ে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা বহুদিনের দাবি। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে এর সুফলটা মাগুরাবাসীও পাবে, বলেন তিনি।

তিনি মেহেরপুর পর্যন্ত রেলযোগাযোগ বিস্তৃত করার বিষয়েও রেলপথ মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন এবং বলেন, ‘কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত রেল সংযোগ করে দেয়া যায়, এটা বেশি দূর হবে না। এর ফলে, সমগ্র বাংলাদেশটাই একটা রেল যোগাযোগের মধ্যে চলে আসবে।’

-বাসস

FacebookTwitter