মানিব্যাগ

মানিব্যাগ
মানিব্যাগ

তাহমিদুর রহমান মননঃ

( বৃষ্টির আনন্দে গল্প লিখতে বসে বিষয় নির্বাচন করতে পারছিলামনা। টেবিলে রাখা প্রায় শূন্য মানিব্যাগটা চোখে পড়লো। সেইসাথে মনে পড়লো কিছুদিন আগে দেখা একটা হিন্দী মুভির নাম – “বাত্তি গুল মিটার চালু”। তেমনি লকডাউনের কারনে মানুষের “ইনকাম বন্ধ খরচ চালু।” তাই মানিব্যাগ নিয়েই লিখবো সিদ্ধান্ত নিলাম। কর্মহীন এই সময়টাতে ফ্যান্টাসিই আমার একমাত্র মানসিক আশ্রয়। আশা করি গল্পটা আপনাদেরকেও কিছুটা আনন্দ দিবে। মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। লকডাউনের জয় হোক)

১.
“মাংস ছাড়া ভাত খাবোনা আমি”
কান্না জড়ানো জেদি কন্ঠে বললো ছোট বোন চুমকি। এবার ক্লাস থ্রীতে উঠেছে সে। দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাগান্বিত চোখে মা তাকালো তার দিকে। বললো- “আমার গায়ের মাংস কেটে খা। ভাতই জুটছেনা মাংস খাবে নবাবজাদি …তোর বাপ তো টাকার বস্তা রেখে গেছে, আমি শুধু সেখান থেকে টাকা বের করবো আর রোজ পোলাও মাংসের ব্যবস্থা করবো…এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ, তা না হলে চড় খাবি বলে দিলাম”
কাঁদতে কাঁদতে বাসার বাইরে বেরিয়ে গেলো চুমকি।

বাবা মরার পর থেকে মা যেনো কেমন হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে তাকে খুব অচেনা লাগে। প্রতিনিয়ত অর্থকষ্ট তাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে। ‘স্বভাব যায়না মরলে, ইল্লত যায়না ধুলে’- কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। প্রাচুর্য এবং দারিদ্রতা এই দুটোই মানুষের স্বভাব বদলে দেয়। আমার বাবা ছিলেন আত্মভোলা স্বভাবের মানুষ। গান-বাজনা, নাটক, অভিনয়- এইসব নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। নেহায়েত সংসারে ভাত যোগাতে একটা ছাপাখানায় কম্পিউটার কম্পোজের কাজ করতেন বাবা। যদিও মা বাবাকে নিষ্কর্মা আর অলস উপাধীই দিয়ে এসেছে সারা জীবন। কিন্তু বাবার প্রতি আমাদের দুই ভাইবোনের ধারনা অনেক উঁচু মানের। আমার ধারনা রাজ-রক্ত ছিলো বাবার শরীরে। কেউ আসলে তাকে ঠিকমতো চিনতে পারেনি- এই অক্ষমতা বাবার নয়, অন্যদের। তিনি ছিলেন এই গ্যালাক্সীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। শুনেছি ভালো মানুষ বেশিদিন বাঁচেনা। বাবাও বাঁচলেন না। গতবছর এক সকালে কাঁচাবাজার করতে গিয়ে বিনা নোটিশে হার্ট স্ট্রোক করে মারা গেলেন তিনি। তারপর থেকে দুই কামরার এই টিনসেড বাসায় ভাড়া থাকি আমরা। মা বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে একটা সেলাই মেশিন সাথে নিয়ে এসেছিলো। সেটাতেই মানুষের জামাকাপড় সেলাই করে কোনোমতে সংসার চালায় সে।…ও হ্যাঁ, এতোক্ষন আমার পরিচয় দিতে ভুলে গিয়েছি- আমার ডাক নাম রাজু। ক্লাস টেন-এ পড়ি। সবাই বলে আমি নাকি অবিকল আমার বাবার মতো দেখতে। স্কুল ছুটির পর থেকে রাত অাটটা পর্যন্ত আমি স্থানীয় একটা মোটর ওয়ার্কসপে মেকানিকের হেল্পার হিসেবে কাজ করি। সেখানে দিনে একশো টাকা পাই এবং সেটা মা’র হাতে দিই। সবকিছু মিলিয়েও সংসার চালাতে মা’কে হিমসিম খেতে হয়। মাঝে মাঝেই একটা ক্ষুদ্রঋন সমিতি থেকে চড়া সুদে টাকা ঋন করে মা। সমিতির নাম- আশার আলো নারী কল্যান সমিতি। প্রতি মঙ্গলবার কিস্তির টাকা নিতে আসে মধ্যবয়সী পেটমোটা একজন। নাম আব্দুল মালেক। সমিতির মালিক সে। আগে মাছের ব্যবসা করতো, গত চার বছর হলো সুদের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা বানিয়েছে। অনেকের ধারনা সে কোটিপতি হয়ে গেছে। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, ভুমিকম্প যা-ই হোক না কেনো প্রতি মঙ্গলবারে আব্দুল মালেক কিস্তি নিতে আসবেই।এলাকার সমস্ত ঋন গ্রহীতা মহিলাদের সে ভাবী ডাকে।
দরজা খোলার সাথে সাথে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে আব্দুল মালেক বলে- “স্লামালেকুম ভাবী, আফনের শইলডা ভালো তো?… আমি বড় ক্লান্ত, একগ্লাস পানি খাওয়াইবেন?”
“জী অবশ্যই। আপনি বসেন”
পানির সাথে চা, বিস্কুটও দেয় মা। আয়েশ করে চেয়ারে বসে বিশ্রী শব্দে চায়ে চুমুক দিয়ে আব্দুল মালেক বলে- “শোনেন ভাবী, মানুষের সুবিধা-অসুবিধা থাকতেই পারে। কোনোদিন যদি কিস্তির ট্যাকা ম্যানাজ করতে না পারেন, সরম করবেন না। আপন মনে কইরা বলবেন। আমি নিজের পকেট থাইকা কিস্তি দিয়া দিমু। আফনে পরে সময় সুযোগ বুইঝা শোধ দিবেন।”
“আপনি কিস্তি দিতে যাবেন কেনো? সব তো আপনারই টাকা”
” ট্যাকা আমার হইলেও ব্যবসার একটা নিয়মকানুন আছে না। ব্যবসা মানেই হিসাব। হিসাবে নড়চড় চলবেনা।কি বুঝলেন? তয় আফনের লেনদেন ভালো। চাইলে আমি আফনেরে এই কিস্তি শোধ হওয়ার আগেই আরো ট্যাকা দিবার পারি, আফনে শুধু মুখ ফুইট্টা বলবেন।”
লোকটাকে মোটেও পছন্দ হয়না আমার। তার নজর ভালোনা। চুমকিও তাকে পছন্দ করেনা। লোকটা তাকে ডাকলে দূর থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে চুমকি। তখন ওর চোখে স্পষ্ট ভয় আর ঘৃনা দেখতে পাই আমি। পুরুষ চেনার ক্ষমতা মেয়েদের জন্মগত, এর সাথে বয়সের কোনো সম্পর্ক নাই। পাড়ার কোন মহিলাই এই মানুষটাকে পছন্দ করেনা, কিন্তু দারিদ্রতার কারনে সবাই তার সাথে বাধ্য হয়ে খাতির রাখে। গায়ে পড়ে রং তামাশাও করে অনেকে। সার দেশজুড়েই এখন এই পরিস্থিতি। অধিকাংশ দরিদ্র মহিলারা ঋনে জর্জরিত। ঋনের বোঝা বইতে না পেরে কেউ করে আত্মহত্যা, কেউ করে আত্মসমর্পণ। হায়রে টাকা!
স্কুল থেকে ফিরে দেখলাম ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে চুমকি। তার দুই গালে কান্নার দাগ। মাংস খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করায় মা মেরেছে তাকে। মা’র মেজাজ একটু বেশি খারাপ হয়ে আছে। তার কারন আজ মাসের দশ তারিখ অথচ বাসাভাড়া যোগার করা সম্ভব হয়নি। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়ে গেছে- তিন দিনের মধ্যে ভাড়া না দিলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে। আমি চুমকির মাথার কাছে বসে তার কপালে হাত রাখলাম। পরীর মতো ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটা। ঘুমের মধ্যেই হাসছে। হয়তো এই মুহূর্তে বাবাকে স্বপ্নে দেখছে সে। বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আজ তার মাংস খাওয়া হতো। অভাব থাকা সত্ত্বেও বাবা আমাদের ভাইবোনের কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখতেন না কখনো। মাংস খেতে ইচ্ছে হয়েছে জানা মাত্র তিনি কাউকে কিছু না বলে সোজা বাজারে চলে যেতেন। খানিক বাদে ফিরে হাতে ধরা বাজারের থলেটা উঁচিয়ে বলতেন- “বলতো এর মধ্যে কি আছে?” তারপর আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতেন- ” হাড্ডি ছাড়া, কলিজা সহ স্পেশাল গরুর মাংস”
বিকালে আমি মোটর ওয়ার্কশপের মালিকের কাছে অগ্রীম পাঁচদিনের বেতন চাইলাম। তিনি বললেন- “টাকা কি দরকার?”
“মাংস কিনবো। ছোট বোনটা মাংস খাবে বলে কান্নাকাটি করছে”
মালিক পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে দিলেন। কাজ শেষ করে ওয়ার্কশপ থেকে বেরোতে বেরোতে রাত নয়টা বেজে গেলো। সমস্ত বাজার ঘুরে একটাও মাংসের দোকান খোলা পেলামনা। মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার।

২.
আনুমানিক রাত দশটা। আজ একটু বেশি গরম পড়েছে। মাঝেমধ্যে কিছুটা বাতাস হয়ে আবার থেমে যাচ্ছে। শরীরটা জুড়িয়ে নিবো বলে বাসার অদূরে রাস্তার পাশে বটগাছের নিচে বাঁশের মাচায় বসে আছি। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে। বটগাছের একপাশে রাস্তা বরাবর সরু একটা। খালের পানিতে চাঁদের প্রতিবিম্ব পড়েছে। বট গাছের শিকড়ের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা জোনাকী জ্বলছে। বহুদিন পর জোনাকী দেখলাম। সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত আলোআঁধারি পরিবেশ।
বটগাছ থাকা সত্ত্বেও এই জায়গাটাকে এলাকার মানুষজন বটতলা নামে চিনেনা। চিনে সন্ন্যাসতলা নামে। লোকমুখে শোনা যায় এক সন্নাসী জ্বিন বাস করে এই গাছে। ফজর অথবা এশার ওয়াক্তে অনেকেই জ্বিনটাকে নামাজ পড়তে যেতে দেখেছে। আজানের সময় বটগাছ থেকে একটা নীল আলোর গোলা মসজিদের দিকে উড়ে যায়। আমি অবশ্য দেখিনি কখনো। বটগাছের পাতার ছোপ ছোপ অন্ধকারের দিকে তাকালাম। একটা পাখি শব্দ করে ডানা ঝাপটালো। খুব ক্লান্তি লাগছে আমার। বাঁশের মাচায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। শুনেছি শৈশবে এই বটগাছের সাথে বাবার খুব সখ্যতা ছিলো। মাঝে মাঝে স্কুল পালিয়ে অথবা মায়ের পিটুনি খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গাছে বসে থাকতেন বাবা। মাঝেমধ্যে গাছেই সারারাত কাটিয়ে দিতেন। মন খারাপ হলে বাবাকে এই মাচায় এসে বসে থাকতে দেখতাম। কোনো কোনো রাতে খুব গরম পড়লে এখানে আমাদের দুই ভাইবোনকে দুইপাশে বসিয়ে মজার মজার গল্প শোনাতেন বাবা। সবই ছিলো তার নিজের বানানো গল্প। সেই গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে ছিলো বিভিন্ন রঙের খুবই ছোট ছোট আকৃতির মানুষ। সর্বোচ্চ ছয় ইঞ্চি লম্বা। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা, বেগুনি ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের মানুষ। তারা সবাই বটগাছটার কোটরের মধ্যে বাস করে। দিনের বেলা বাইরে বের হয়না বলে কেউ তাদের দেখতে পায়না। রঙিন মানুষগুলো বাইরে বের হয় গভীর রাতে, সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন। আকাশে চাঁদ উঠলে ছোট্টো মানুষগুলোর আনন্দের সীমা থাকেনা। জোছনার আলোয় বটগাছের ডালে ডালে খেলে বেড়ায় তারা। হৈচৈ করে এডাল থেকে ওডালে ছুটে বেড়ায়। কেউ কেউ গাছের লতা ধরে টারজানের মতো ঝুল খেয়ে খালের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতার কাটে। একে অন্যের গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। কেউ কেউ আবার খুব মিহি গলায় গান ধরে। ওরা ভালো পল্লীগীতি গাইতে পারে। আমরা দুই ভাইবোন মন্রমুগ্ধের মতো বাবার গল্প শুনতাম। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম- “আচ্ছা বাবা, রঙিন মানুষেরা কি খায়?”
বাবা বললেন- “ওরা শুধুই চাঁদের আলো খায়”
“কিভাবে খায়?”
“ওরা ওদের লম্বা জিহবা মুখের বাইরে বের করে রাখলে তাতে চাঁদের আলো এসে পড়ে। ওরা তখন অনেকটা গাছের সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতির মতো করে সেটা খায়”
“ওরা কি টয়লেটে যায়? কি ত্যাগ করে?”
“খুব সহজ বিষয়, ওরা আলো খায় সুতরাং অন্ধকার ত্যাগ করে”
এই কথা শুনে চুমকি খিলখিল করে হেসে বাবার কোলে ঢলে পড়তো।…আহারে আমাদের বাবা। আপনার সেই আদরের রাজকন্যা যে আজ ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে- তা কি আপনি জানেন?
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমে চোখ বুঁজে এসেছিলো বুঝতে পারিনি। কপালে খুব ঠান্ডা একটা হাতের স্পর্শে ধরমড়িয়ে উঠে বসলাম। আবছা অন্ধকারে আমার সামনে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ভর্তি লম্বা লম্বা জটা ধরা চুল। এই প্রচন্ড গরমের মধ্যেও মানুষটার শরীরে কাঁথা জড়ানো। চিনতে পারলাম তাকে- কাঁথাপাগলা। সবসময় গায়ে কাঁথা জড়িয়ে থাকে বলে তাকে সবাই কাঁথাপাগলা নামে ডাকে। কাঁথাঁপাগলা কখনোই কথা বলেনা। সম্ভবত বোবা। বছর দশেক আগের এক সকালে কাঁথা পাগলাকে এই বটগাছের নিচে বসে থাকতে দেখে সবাই। কোথায় থেকে এসেছিলো কেউ জানেনা। রাতে কবরস্থানে শুয়ে ঘুমায় পাগলটা। কোনো এক অজানা কারনে বাবার সাথে খুব খাতির ছিলো কাঁথাপাগলার। সময়-অসময়ে প্রায়ই বাবা তাকে সাথে করে বাসায় এসে মা’কে বলতেন- “আমরা দুজনেই ক্ষুধার্ত, আমাদেরকে ভাত খেতে দাও”
তারপর বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে দুজনেই বসে পরতেন। ভাত খেয়ে কাঁথাপাগল বিদায় হলে বাবার উদ্দেশ্যে রাগে গজগজ করতো মা। তা শুনে হাসিমুখে মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে গান ধরতেন বাবা- ” খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার, এই তোমাদের পৃথিবী। এর বাইরে জগৎ আছে তোমরা জানোনা…”
মা তখন আরো উচ্চস্বরে বকা-ঝকা শুরু করতো। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তো বাবার গানের আওয়াজ- “তোমাদের কোনটা আসল, কোনটা নকল। কোনটা শুধুই জবরদখল, তোমরা নিজেই জানোনা…”
কোনো এক রহস্যময় কারনে বাবার মৃত্যুর পর থেকেই কাঁথাপাগলাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। যেমন হঠাৎ করে উদয় হয়েছিলো তেমনি হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেলো। তারপর আজ এই প্রথম কাঁথাপাগলাকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তার গা থেকে হালকা মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। গন্ধটা আমার খুব পরিচিত লাগছে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিনা। আমি কি বলবো বা কি করবো বুঝতে পারছিনা। সত্যি বলতে একটু ভয় ভয় লাগছে আমার। কাঁথা পাগলা আমার মাথায় আস্তে করে হাত রাখলো। আমি লক্ষ্য করলাম আমার মেরুদণ্ড বেয়ে অপার্থিব অনুভূতির একটা স্রোত বয়ে গেলো। অপূর্ব শান্তি অনুভব করলাম আমি। কাঁথাপাগলা তার কাঁথার মধ্যে থেকে কালো রঙের চারকোনা কিছু একটা বের করে আমার হাতে দিলো। চোখের কাছে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলাম সেটা। একটা চামড়ার মানিব্যাগ। পরক্ষণেই মুখ তুলে দেখলাম কাঁথাপাগলা নেই ! দু’পাশে রাস্তায় যতদূর চোখ যায় কোথাও তাকে দেখতে পেলামনা। মূহুর্তের মধ্যে যেনো উধাও হয়ে গেলো আস্ত মানুষটা। কাঁথাপাগলা মানুষ নাকি অন্য কিছু? এবার প্রচন্ড ভয়ে গায়ে কাঁটা দিলো আমার। তড়িঘড়ি লাইটপোষ্টের নিচে এসে দাঁড়ালাম। আলোতে মানিব্যাগটা ভালোমতো দেখে চিনতে পারলাম। এটা বাবার মানিব্যাগ ! খুলে দেখলাম ভিতরটা সম্পুর্ন ফাঁকা। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত মানিব্যাগটার কথা আমাদের কারো মাথায় আসেনি। এটা কাঁথাপাগলার কাছে কিভাবে এলো? কি হচ্ছে এসব? আমি আর বেশিকিছু ভাবতে পারলামনা। হতভম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষন। তারপর কিছুটা স্বাভাবিক হতে পরম আবেগে মানিব্যাগটা আমার গালে ছোঁয়ালাম। এটাতে বাবার স্পর্শ লেগে আছে। ঠিক তখনই কাঁথাপাগলার গা থেকে আসা মিষ্টি গন্ধটা চিনতে পারলাম আমি। বাবা’র প্রিয় পারফিউমের গন্ধ এটা। দারুণ অভাবের দিনেও পারফিউম ব্যবহার করতে ভুলতেন না আমার মহারাজা বাবা। ওয়ার্কশপ থেকে নেয়া পাঁচশো টাকার নোটটা স্বযত্নে মানিব্যাগে রেখে সেটা পকেটে ভরে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। বাসায় ঢোকার মূহুর্তে একবার পিছনে ফিরে বটগাছটার দিকে তাকালাম। মনে হলো- সেখানে বসে কেউ যেনো আমার উপর নজর রাখছে। এই পৃথিবী বড় রহস্যময়।

৩.
মাংসের দাম দিবো বলে বাবার মানিব্যাগটা খুলে চমকে উঠলাম আমি। ভিতরে দুটো পাঁচশো টাকার নোট ! হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলাম- হুবহু একই রকম দুইটা নোট। এমনকি ষ্ট্যাপলার পিনের ফুটো, তার পাশে ছোট্ট একটা কালো দাগ- সব এক। দুটোই আসল পাঁচশো টাকার নোট। বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতেই আমার ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আমি মাংসের পলিব্যাগটা দোকানীকে দিয়ে বললাম- “হাফকেজি না, এক কেজি মাংস দিন আমাকে” তারপর চোখ বুঁজে বাবার মুখটা স্মরণ করে মনে মনে বললাম- “থ্যাংক ইউ বাবা”
দ্বিতীয় পাঁচশো টাকার নোটটা মানিব্যাগে ভরে বাসায় ফিরলাম। মাংস দেখে চুমকির মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। আহলাদি কন্ঠে সে বললো- “আমি জানতাম আজ বাসায় মাংস আসবে”
মা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো- “মাংস কিনার টাকা পেলি কোথায়?”
আমি কোনো কথা না বলে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে মা’র চোখের সামনে তুলে ধরলাম। প্রায় ছোঁ মেরে সেটা আমার হাত থেকে নিয়ে মা বললো- “কোথায় পেলি এটা?”
গতরাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম মা’কে। টাকার নোট একটা থেকে দুটো হওয়ার ঘটনাও বললাম। চোখ বড় করে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছিলো চুমকি। সে বলে উঠলো- “আমি আগেই জানতাম। কাল যখন ভাত না খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম তখন বাবাকে স্বপ্নে দেখেছি। বাবা আমার চোখ মুছে দিয়ে বললো- কাঁদিসনা চুমকি, এই দ্যাখ তোর জন্য মাংস এনেছি”
আমি চুমকির কপালে চুমু খেলাম। মানিব্যাগ হাতে নিয়ে খাটের কোনায় ধপ্ করে বসে পড়লো মা। তাঁর চোখে জল। ধীরে ধীরে মানিব্যাগ খুললো সে। সেদিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে উঠলাম আমি। মানিব্যাগের ভিতরে আবারও দুটো পাঁচশ টাকার নোট। হুবহু একই রকম।
ভাইবোন দুজনেই স্কুলে গেলাম না সেদিন। বহুদিন পর তৃপ্তি সহকারে ভাত খেলাম আমরা তিনজন। তারপর বাবার আত্মার শান্তির জন্য মা আর আমি নফল নামাজে দাঁড়ালাম। চুমকিও ওড়না মাথায় আমাদের সাথে যোগ দিলো।
মানিব্যাগে টাকা কপি হতে মাত্র নয় মিনিটের মতো সময় লাগে। তারচেয়ে বড় কথা- নোট একটা রাখলে দুই’টা হয়, দুই’টা রাখলে হয় চার’টা। অর্থাৎ যতো টাকা রাখা হয় ঠিক তার দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেইসাথে আরো একটা বিষয় আবিস্কার করলাম আমি। টাকা ভরে মানিব্যাগ আমার পকেটে রাখতে হচ্ছে। বাইরে রাখলে কাজ হচ্ছেনা। বিকেল নাগাদ আমি মহা আনন্দে বত্রিশ হাজার টাকা বানিয়ে ফেললাম।
সন্ধ্যায় ওয়ার্কশপ থেকে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দেখলাম- কিস্তির টাকা নিতে যথারীতি উপস্থিত হয়েছে আব্দুল মালেক। চেয়ারে বসে বিশ্রী শব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছে সে। মা তার দিকে বেশ কিছু পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললো- ” একবারে সমস্ত কিস্তির টাকা দিয়ে দিলাম। ঋন পরিশোধ”
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলো আব্দুল মালেক। তার হাতে ধরা কাপ থেকে কিছুটা চা ছলকে নিচে পড়লো। সে অবাক কন্ঠে বললো- “বলেন কি ভাবী! কোনো গুপ্তধন হাতে পাইছেন নাকি?”
উত্তরে মা শুধু নিঃশব্দে হাসলো। মনে মনে হয়তো বললো- “আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা গুপ্তধন পেয়েছি”
আব্দুল মালেক বিদায় নেয়ার পর হঠাৎ করে একটা দুঃশ্চিন্তা আমার মাথায় এলো। সঙ্গে সঙ্গেই আমি কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। সবক’টা টাকার নম্বর এক। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ি এগুলো জাল টাকা হয়ে যাচ্ছে। আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। মূহুর্তেই আনন্দ পরিনত হলো ভয়ে।
বিষয়টা মা’কে জানাতে তার মুখটাও শুকিয়ে গেলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো- “এখন তাহলে কি হবে?”
শুকনো কন্ঠে আমি বললাম- “জানিনা মা”
রাতে শোবার পরে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকলাম। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। আসার কথাও না। দেয়ালে ঝুলানো বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। যুবক বয়সে তোলা ছবিটায় বাবা হাসছেন। ঠিক যেনো আমার চোখের তাকিয়ে আছেন তিনি। জীবদ্দশাতেও সবসময়ই বাবার ঠোঁটে হাসি লেগে থাকতো। তিনি বলতেন- “সবসময় হাসিমুখে থাকবি রাজু বুঝলি। তাহলে দুঃখ-কষ্ট তোর কাছে ভিড়বেনা। দুঃখ হাসিকে ভিষন ভয় পায়”
সময় দেখবো বলে মাথার কাছে রাখা হাতঘড়িটা চোখের কাছে আনলাম। রাত দুইটা পঁয়ত্রিশ। সেই সময় আচমকা আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমি হাতঘড়িটা মানিব্যাগের মধ্যে পুরে সেটা আমার ট্রাুউজারের পকেটে রেখে দিলাম। আনুমানিক পনেরো মিনিট পরে মানিব্যাগ খুলে আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এলো। কারন সেখানে এখন হুবহু একই রকম দুইটা হাতঘড়ি !

৪.
এখন আর টাকা কপি করিনা আমি। আমরা দরিদ্র হলেও আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা ধনী। বড়খালার কিছু সোনার গহনা একদিনের জন্য ধার নিয়ে এসেছিলো মা। হীরের আংটি, কানের দুল, গলার মালা, হাতের বালা ইত্যাদি। গহনাগুলো মানিব্যাগে কপি করে নিয়ে আবার সেগুলো বড়খালাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন সেগুলো থেকে প্রয়োজনমতো আরো গহনা কপি করে মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্বর্নকারের দোকানে বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে আসি।
হারিয়ে ফেলার ভয়ে মানিব্যাগটা কখনোই সাথে করে বাইরে বের হইনা আমি। মায়ের ঘরে পুরনো কাঠের আলমারিতে তালাবদ্ধ থাকে মানিব্যাগ। দেখতে দেখতে জিরো থেকে হিরো হয়ে গেলাম আমরা। বাড়ি-গাড়ি এখন আর আমাদের স্বপ্ন নয়, পরিকল্পনা। টাকা মানুষের শুধু স্বভাব বদলে দেয়না, চেহারাও বদলে দেয়। মা-বোনের আনন্দ ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। তাদের এতো সুন্দর উজ্জ্বল চেহারা আমি আগে কখনো দেখিনি। মা’র মেজাজও আর খিটখিটে হয়না। তার মুখে সবসময় হাসিহাসি ভাব। এছাড়া নিজের মধ্যে আমি আরো একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। তা হলো সাহস। নিজেকে এখন ভিষণ সাহসী মনে হয়।
যদিও লোকসমাজে জানাজানি হওয়ার ভয়ে আমরা মানিব্যাগের বিষয়টা গোপন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কোনো কিছুতেই তাড়াহুড়ো না করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পুরোপুরি পারছিনা। যথাসাধ্য গোপনীয়তা সত্ত্বেও একসময় আমাদের চালচলনের পরিবর্তন প্রতিবেশীদের নজর এড়ালোনা। তারমধ্যে চুমকি একদিন ওর খেলার সাথীদের সাথে গল্পে গল্পে মানিব্যাগের ঘটনাটা বলে দিলো। তারপর সেই বাচ্চাগুলোর কাছ থেকে ঘটনা তাদের মায়েরা শুনলো…ব্যাস। ভর দুপুরে কাঁথা সেলাই আর উঁকুন বাছার আড্ডায় মহিলাদের দল বিষয়টা নিয়ে মহা উৎসাহে কানাঘুষা শুরু করে দিলো। বলা বাহুল্য এই ধরনের মহিলা নেটওয়ার্কের ডাটা ট্রান্সফারের গতি ও ক্ষমতা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। সন্ধ্যার মধ্যেই সমস্ত এলাকা জুড়ে ভাইরাসের চেয়ে দ্রুত গতিতে যে কাহিনী ছড়িয়ে পড়লো সেটা এইরকম-
“কাঁথা পাগলা মানুষ ছিলোনা, ছিলো মানুষ রূপী জ্বিন। এবং সে-ই আসলে ছিলো বটগাছের সন্নাসী জ্বিন। তার কাছে একটা অলৌকিক মানিব্যাগ ছিলো। যে মানিব্যাগের টাকা কোনোদিন শেষ হয়না। সেটা থেকে যখন যতো খুশি টাকা নেয়া যায়। আমার বাবা ওই মানিব্যাগটার লোভেই কাঁথা পাগলার সাথে খাতির জমিয়েছিলো। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে বাবা কাঁথাপাগলার কাছ থেকে মানিব্যাগটা কেড়ে নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে অথবা মেরে ফেলেছে। গান, বাজনা, নাটক করা মানুষের দ্বারা সবই সম্ভব। সেজন্যই কাঁথাপাগলাকে বহুদিন হলো আর কোথাও দেখা যায়না। এবং কাঁথা পাগলার অভিশাপেই আমার বাবা রাস্তায় পড়ে মরে গেছে, স্ট্রোক-ফোক কিছুনা। মানিব্যাগটা দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখার পর এখন আমরা সেটা থেকে টাকা নিয়ে খরচ করে যাচ্ছি।”
মানুষের কৌতূহল যে এমন মারাত্মক মহামারী রূপ নিতে পারে- তা আমাদের জানা ছিলোনা। হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে আমরা বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। নেহায়েত প্রয়োজনে বাইরে গেলে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে- ” কিরে রাজু, ঘটনা কি সত্য?”
আমি কোন উত্তর দিইনা। তখন সে বলে- “ওওও… এতো অহংকার? ঘটনা তাইলে সত্য, ট্যাকার গরমে কথা বন্ধ”
আশেপাশের মহিলারা বিভিন্ন ছুতোয় মা’র কাছে আসে। কথার ছলে জানতে চায়- “ভাবি কি সব শুনতাছি, আফনের চুমকি বাচ্চাগো লগে গল্প করছে। কথা কি সত্য?”
মা মৃদু হেসে সত্য আর মিথ্যার মাঝামাঝি একটা উত্তর দেয়- “বাচ্চা মানুষের কথা আপনারা বিশ্বাস করেন?”
একদিন মা আর আমি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম- সামনের জানুয়ারী মাসে আমরা অন্য কোনো অপরিচিত শহরে চলে যাবো। একটা ফ্লাট কিনে সেখানেই থেকে যাবো। এই শহরে ফিরবোনা কখনো।
কিছুদিন পরের ঘটনা। কথায় আছে- সুখের সময় দীর্ঘ হয়না। আমাদেরও হলোনা। একদিন ভোরবেলা মা’র চিৎকারে ঘুম ভেঙে তার ঘরে ছুটে গেলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হাউমাউ করে মা কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতেই আলমারির দিকে ইশারা করলো সে। আমি দেখলাম- আলমারির দরজা হা করে খোলা। কাপড়চোপড় সব মেঝেতে পড়ে আছে। ঘরের জানালার দুটো শিক উপড়ে দুপাশে এমন ভাবে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে যাতে পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ সেদিক দিয়ে ঢুকতে পারে। বুঝতে দেরি হলোনা আমার, বাবার মানিব্যাগ চুরি হয়ে গেছে।

৫.
একদিন পর। আবারও প্রচন্ড গরম পড়েছে আজ। সন্ধ্যার আগে আকাশে ঘন কালো মেঘ জমলো। থমথমে আবহাওয়া। বাতাস নেই। একটা গাছের পাতাও নড়ছেনা। ছবির মতো স্থীর হয়ে আছে প্রকৃতি। ঝড়-বৃষ্টির লক্ষন। জানালা দিয়ে দেখলাম- সন্নাসতলা’র বাঁশের মাচাটা ফাঁকা। ভাবলাম- ওখানে গিয়ে বসে থাকবো কিছুক্ষণ। বৃষ্টি এলে ভিজবো। চুমকিকে বললাম- “বাইরে যাচ্ছি। তুই যাবি আমার সাথে?”
” না ভাইয়া, তুমি যাও। আমার স্কুলের পড়া আছে।”
আমি বেরোনোর সময় চুমকি আমাকে একটা চকলেট খেতে দিলো। লাল কাগজে মোড়ানো এটা ওর খুব পছন্দের চকলেট। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা। চকলেট হাতে নিয়েই বাইরে বের হলাম।
মাচায় বসে বসে বাবার কথা ভাবছি। মানিব্যাগ চুরি যাওয়ার পর থেকে আর কোনোকিছুই ভালো লাগছেনা। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। সেইসাথে দমকা বাতাস। ঘন মেঘের কারনে সন্ধ্যাবেলায় রাতের মতো অন্ধকার নেমে এলো। আজ কি আবার কাঁথা পাগলের সাথে দেখা হতে পারে? বাবা কি সব ঘটনা জানতে পেরেছেন?
একসময় মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। সমস্ত শরীর ভিজে যাচ্ছে আমার। ভিষন শান্তি লাগছে। বৃষ্টির হয়তো কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে। যে কারনে বৃষ্টিতে ভিজলে জীবনের বড় বড় দুঃখ-কষ্টগুলোকেও খুব তুচ্ছ মনে হয়।
কতক্ষন বৃষ্টিতে ভিজেছি মনে নাই আমার। কেমন যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ কিছু একটা অনুভব করে চমকে উঠলাম। মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেলো আমার। এক দৌড় দিয়ে বাসায় ঢুকলাম। সবেমাত্র নামাজ শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে মা। আমি কাকভেজা শরীর নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ আমার এতো আনন্দের কারন মা বুঝতে পারলোনা। জিজ্ঞেস করলো- ” কি হয়েছে রাজু? এতো খুশি কেনো? মানিব্যাগ ফেরত পেয়েছিস?”
আমি বললাম- ” না মা। ফেরত পাইনি। পাওয়ার প্রয়োজন নাই”

প্যান্টের পকেট থেকে লাল কাগজে মোড়া দুইটা চকলেট বের করে মা’র দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। বললাম- ” এই দেখো মা। মানিব্যাগ নয়, ক্ষমতা আছে আমার নিজের মধ্যে !”

-শিশির

FacebookTwitter