শিক্ষা ও কর্মসংস্থানঃ
দেশে শিক্ষিত বেকরাদের মধ্যে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে ১৪ দশমিক ২৭ ভাগ চিকিৎসক ও প্রকৌশলী বেকার।
মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নারী শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের হার ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)’র সর্বশেষ শ্রম জরিপে এমন তথ্য উঠে আসে।
এদিকে ২০১৯ সালের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতের ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশই বেকার।
দেশের স্নাতক (এমবিবিএস-বিডিএস) শেষ করা চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের বেকারত্ব নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা। দেশ রূপান্তর’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
তেমনি একই বেকার সাদিয়া সায়রা। ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৬ সালে বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) পাস করেন তিনি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ করেন দুই বছরের ইন্টার্নি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইন্টার্নির সময়কালে মাসে ১৫ হাজার টাকা করে সম্মানী দেয় সাদিয়াকে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে মেডিকেল অফিসার (এইচএমও) হিসেবে ওই প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেন তিনি। তবে সেটি ছিল বিনা পারিশ্রমিকে। এক বছর দায়িত্ব শেষে বর্তমানে উচ্চতর (এফসিপিএস) ডিগ্রির ভর্তি কোচিং করছেন তিনি।
এ বিষয়ে সাদিয়া বলেন, ‘আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা জেনারেল বিষয়ে পড়াশোনা করেছে তাদের সবাই এখন চাকরি করছে। এক্ষেত্রে আমি ভিন্ন। এখনো পরিবার থেকে টাকা নিয়ে কোচিং করছি, হাত খরচ নিচ্ছি। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা দিতে অনেক টাকা দরকার। ভর্তি হলে আরো টাকা দরকার। সবই নিতে হবে পরিবার থেকে, যা ভীষণ লজ্জার! তাই ভাবছি ডাক্তারি না করে হেলথ রিলেটেড গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবো।’
বিবিএস’র তথ্য মতে, দেশের ১৪ দশমিক ২৭ ভাগ চিকিৎসক ও প্রকৌশলী বেকার। মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া নারী শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের হার ৩১ শতাংশ। তালিকায় মেডিকেল ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের তুলনায় কম বেকার রয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীরা। আর ১০ দশমিক ২৫ স্কোর নিয়ে সাধারণ স্নাতক ডিগ্রিধারীরা চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের চেয়ে আরো ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
এ বিষয়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুর্শিদ বলেন, ‘ডাক্তার ও প্রকৌশলীরা বেকার কথাটা ঠিক নয়। তারা হয়তো পছন্দসই চাকরি পাচ্ছেন না। এটা বেকারত্ব নয়। যারা চাকরি পায় তারা আবার গ্রামে যেতে চায় না। মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। এমবিবিএস পাস করা একজন ব্যক্তি চাইলে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করতে পারে। তবে প্রকৌশলীদের ব্যাপারটা ভিন্ন।’
দেশে চিকিৎসকের ঘাটতির থাকার পরেও চিকিৎসকদের বেকারত্বের হার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নিয়ম মতে, প্রতি এক হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একজন চিকিৎসক থাকতে হয়। সেখানে বাংলাদেশে আছে প্রায় তিন হাজার লোকের জন্য একজন চিকিৎসক। দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি হিসাবে ধরলেও মোট ১ লাখ ৬০ হাজার চিকিৎসক প্রয়োজন। ফলে চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৭০ শতাংশ চিকিৎসক ঘাটতি রয়েছে দেশে।
এদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) হিসাবে, স্বাধীনতার পর থেকে স্নাতক শেষ করে চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধন নিয়েছেন প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী। যদিও তাদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে মারা গেছেন। স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টদের হিসাবে দেশে এখন সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোতে চিকিৎসক আছেন ৩০ হাজারের মতো।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন সিলেবাস পড়ে আসা ছেলেমেয়েরা বেকার থাকছে এটা হতাশার। মূলত চিকিৎসা খাতে নানা অনিয়মের কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্টস ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানাগুলোতে কর্মীর সংখ্যা হিসাব করে ডাক্তার নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়া ডাক্তারদের নিজেদেরও স্বনির্ভরতার পথ খুঁজতে হবে।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বেকারত্বের সংজ্ঞায় বলা হয়, কাজপ্রত্যাশী হওয়া সত্ত্বেও সপ্তাহে এক দিন এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ না পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হবে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পেলে তাকে আর বেকার বলা হয় না।
ঢাকার জেড এইচ শিকদার উইমেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা তাসনিম বলেন, ‘অধিকাংশ বাবা-মা মেয়েদের ডাক্তারি পড়ান ভালো পাত্রের সন্ধানে। একবার বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের চিকিৎসা পেশায় টিকে থাকা কষ্টকর। ফলে মেয়েরা বেকার থাকছে বেশি।’
নর্দার্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ওসমান গনি আরাফাত বলেন, ‘এমবিবিএস পাস করার পর চাকরি করার জায়গাটা কোথায়? বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোতে চাকরি পেলে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন। সপ্তাহে সাত দিনই কাজ করতে হয়। আবার ব্যবসা খারাপ হলে মালিকরা বেতন আটকে রাখেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে গেলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না হলে রোগী আসে না। এখানে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর। এজন্য অনেকে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন।’
বুয়েট শিক্ষার্থী শামীম আহমেদ বলেন, ‘ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়াররা বেকার থাকে সামান্য। তবে অনেকে দেশের সিস্টেমের প্রতি বিরক্ত হয়ে বেকার থাকে। তারা আবার দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য পড়াশোনা করেন।’
শিক্ষায় বড় ধরনের গলদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের ১১১টি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৫২ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করেন। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১০ হাজারের মতো। বিএমডিসির নীতিমালা অনুসারে, কোনো মেডিকেল কলেজে বছরে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলে সেখানে ১৯৮ জন শিক্ষক থাকতে হবে। এ হিসাবে দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে ২৫ হাজার শিক্ষক থাকা দরকার।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. নিতিশ কৃষ্ণ দাস বলেন, ‘চিকিৎসা শাস্ত্র অন্য শিক্ষার মতো নয়। প্রথমত এখানে চিকিৎসক হওয়ার তীব্র প্যাশন (ঝোঁক) থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে। এ যোগ্যতা-দক্ষতা স্নাতক (এমবিবিএস) লেভেলেই শিক্ষার্থীদের দিতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্লাসরুমে এটা আমরা দিতে পারছি না। আবার অনাগ্রহ নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী এমবিবিএস পাস করছে। ফলে প্যাশন, যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে বেকারত্ব বাড়ছে।’
বিআইডিএসের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষায় এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। বেসরকারি মেডিকেলগুলোতে টিচার, লজিস্টিক সাপোর্ট, গবেষণা ল্যাব, আবাসন সবকিছুর ঘাটতি রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা টেকনিক্যালি সাউন্ড হতে পারছে না। এমবিবিএস পর্যায়ে ব্যবহারিক শিক্ষার অভাবে তারা বেকার থাকছে।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহবুব ই রশীদ বলেন, ‘ডাক্তারদের বেকারত্ব কমাতে উন্নত বিশ্বে রেফারেল সিস্টেম চালু আছে। জরুরি অবস্থা ছাড়া যেকোনো অসুখের জন্য রোগীকে প্রথমে একজন সাধারণ এমবিবিএস পাস করা ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। তারা প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি মনে করেন রোগীর উন্নতমানের চিকিৎসা লাগবে, তাহলেই শুধু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠান বা রেফার করেন। কিন্তু আমাদের দেশে সামান্য সর্দি-কাশি বা ঠাণ্ডাজ্বর হলেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে সরাসরি চলে যায়। এতে এমবিবিএস ডিগ্রিধারীদের মধ্যে কাজের সুযোগ কমে গেছে।’