বান্দরবানেও জিকে শামীমের দখলকৃত সম্পত্তির খোঁজ

অনলাইনঃ
বান্দরবানেও দখলবাজির থাবা বসিয়েছিলেন র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ‘টেন্ডার মাফিয়া’ যুবলীগ নেতা জি কে শামীম।

জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র নীলাচলের পাশেই ‘সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার’ স্থাপনের জন্য ৬০ একর জমি কেনা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের একজন শামীম। ৬০ একর জমি কিনলেও প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিষ্ঠানটির দখলে আছে প্রায় ১০০ একর জমি। আর এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বান্দরবান জেলা পুলিশকে ফাঁড়ি তৈরির জন্য দান করা হয়েছে সাড়ে ১৮ শতক জমি। এর জন্য একটি দ্বিতল ভবনও নির্মাণাধীন।

বান্দরবানের রুমা-থানচি সড়কের জনপ্রিয় নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের খানিক পেরিয়ে আরেকটু সামনে গেলেই চোখে পড়ে একটি সাইনবোর্ড। এতে লেখা ‘ক্রয় সূত্রে এই জায়গার মালিক সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার’। সাইনবোর্ডের আওতাধীন এই অংশের দেড় শ‘ গজের মধ্যেই রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। তবে সেই দূরত্বও আরেকটু কমেছে। কারণ সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা বান্দরবান জেলা পুলিশকে এই ফাঁড়ির জন্য প্রায় সাড়ে ১৮ শতক জমি দান করেছে। ফাঁড়ির জন্য সেখানে একটি দ্বিতল ভবনও করে দেওয়া হচ্ছে।

এই সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার পরিচালকদের একজন ‘টেন্ডার মাফিয়া’ যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম)। অগাধ বিত্ত-বৈভব আর প্রভাবশালী এই যুবলীগ নেতার আয়ের টাকা বিনিয়োগ হয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও। কোম্পানি গঠন করার মধ্য দিয়ে বান্দরবান সদরের মৌজায় প্রায় ৬০ একর জমি কেনা হয়েছে সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের নামে।

জি কে শামীম এখানেও কায়েম করেছেন তার দখলদারি। সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড এখানে কমপক্ষে ১০০ একর জমি জবরদখল করেছে বলে অভিযোগ সাইঙ্গ্যা মারমা পাড়া, হাতিভাঙা ত্রিপুরা পাড়া ও লাইমী (বম) পাড়ার বাসিন্দাদের। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে স্থানীয় লোকজনকে নানাভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রশাসনকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে পুলিশ ফাঁড়ির জন্য জমি দান করে সেখানে পাকা ভবনও করে দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতল ভবনটি নির্মাণের কাজ এখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। শিগগিরই এই ভবনে পুলিশ ফাঁড়ি স্থানান্তরিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জেনেছে স্থানীয় লোকজন।

সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার পরিচালকদের সভার একটি রেজল্যুশন কপি’র বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের একটি বোর্ড মিটিং বান্দরবান সদরের ৩১৩ নম্বর রেজি. অফিসে অনুষ্ঠিত হয়। তবে, এই কোম্পানির কোনো অফিস বান্দরবান সদরে নেই। এ কারণেই মূলত বান্দরবান সদরের ৩১৩ নম্বর মৌজা এলাকায় রেজি. অফিস ঠিকানা দেওয়া হয়েছে।

রেজল্যুশনের তথ্য অনুযায়ী, ওই দিন কোম্পানির চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন মন্টুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল করিম চৌধুরী স্বপন, পরিচালক গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জামিল উদ্দিন শুভ, অপর চার পরিচালক যথাক্রমে এস এইচ এম মহসিন, উম্মে হাবিবা নাসিমা আক্তার, জিয়া উদ্দিন আবির ও জাওয়াদ উদ্দিন আবরার উপস্থিত ছিলেন।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন মন্টুকে বান্দরবান সদরের ৩১৩ মৌজার ৮০৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের ০.১৮৩৭ একর (প্রায় সাড়ে ১৮ শতক) তৃতীয় শ্রেণির জমি বিক্রি সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদনে ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

পরে এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জেলা পুলিশ সুপার বরাবরে জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই জমি দান করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আবার বোর্ডসভায় ‘পুলিশ সুপার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা’কে জমি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে ‘মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার, পুলিশ সুপার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা’ বরাবরে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে ‘পুলিশ সুপার’ পদের বিপরীতে রেজিস্ট্রেশন না করে ব্যক্তি ‘মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার‘ লেখা হয়েছে।

আবার এই কোম্পানির বোর্ডসভায় জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত হলেও ‘দান’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি এবং সেই জমিতে পুলিশ ফাঁড়ির জন্য ভবন নির্মাণ করে দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে জমি দানের পর কোম্পানির টাকায় ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন বান্দরবান জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। আরও পড়ুনঃ

যা দখলমুক্ত করেছিলেন আনিসুল, তা রাতারাতি বেদখলে

এই রিসোর্টের পাশে থাকা তিন পাড়ার লোকজন জানায়, এই রিসোর্টের কারণে তিনটি পাড়ার বাসিন্দারা উচ্ছেদ আতঙ্কে আছে। এ নিয়ে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের মামলা-মোকদ্দমা চলছে। কিন্তু প্রভাবশালী রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না স্থানীয় লোকজন। অধিকন্তু কোম্পানির কাছ থেকে জমি ও ভবন গ্রহণ করায় ওই তিন পাড়ার মানুষ মনে করছে, জেলা পুলিশ মূলত এই কোম্পানির আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করছে। আরও পড়ুনঃ

কিশোর গ্যাং সেভেনষ্টার গ্রুপের প্রধান গ্রেফতার

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, জি কে শামীম সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ৬০ একর জমি কেনার কথা প্রচার করে। কিন্তু এখন কোম্পানির দখলে আছে প্রায় ১০০ একর জমি। বর্তমানে সেখানে প্রতি একর জমির গড় মূল্য প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। সেই হিসাবে বাড়তি ৪০ একর জমি দখল করে প্রায় দুই কোটি টাকার জমি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে কোম্পানিটি।

-ডিকে

FacebookTwitter