দোকানি থেকে বনে গেলেন কোম্পানীর মালিক

দোকানি থেকে বনে গেলেন কোম্পানীর মালিক
মাহিন

আইন আদালতঃ
রাষ্ট্রায়ত্ব বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ৬১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তানাকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মহিউদ্দিন ওরফে মাহিন ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মাহিনের অবৈধ সম্পদের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

একসময়ে পাটুয়াটুলীর অডিও ক্যাসেটের দোকানি মাহিন বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামে ওই টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের করেন। দেশ রূপান্তর’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।

দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এ সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাহিনের মালিকানাধীন তানাকা গ্রুপের নামে প্রায় ১২০ কোটি টাকা, মুহিব স্টিল কোম্পানির নামে প্রায় ৯১ কোটি টাকা, মারহাবা টেক্সটাইল মিলসের নামে ৪৫ কোটি টাকা, মাহিন অ্যাপারেলসের নামে ১০৯ কোটি টাকা, এআরটি শিপব্রেকিং লিমিটেডের নামে ৫০ কোটি টাকা এবং মিউচুয়াল কনসার্ন করপোরেশন লিমিটেডের নামে ২০০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।

দুদকের কর্মকর্তারা জানান, এসব ঋণের খেলাপি হয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে এসব ঋণের কয়েকটি পুনঃতফসিল করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এক এমডি। তিনি কোনোরকম জামানত ছাড়াই ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন মাহিনকে। বিনিময়ে তার কাছ থেকে আজিমপুরে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটসহ অনেক সুবিধা নিয়েছেন।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, গতকাল মঙ্গলবার কমিশনের সভায় তানাকা গ্রুপের এমডি মহিউদ্দিন মাহিন, তার স্ত্রী নাফিসা সানজিদা ও ভাই আলী হোসেনের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৬(১) ধারা মোতাবেক নোটিশ জারির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিগগিরই এ নোটিশ ইস্যু করা হবে।

দুদকে করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, মাহিন ছিলেন পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর একজন সাধারণ দোকানদার। তার গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষিণ রামেরকান্দা গ্রামে। বাবার নাম আবদুল মজিদ। একসময় অডিও ক্যাসেটের দোকান ছেড়ে চলে যান জাপানে। বিয়ে করেন এক জাপানি নারীকে। যদিও ওই নারীর সঙ্গে তার সংসার বেশিদিন টেকেনি। সেখান থেকে ফিরে এসে তানাকা ক্যাসেট (ফিতা ক্যাসেট) ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক বছর পর ফিরে এসেই যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান তিনি। হয়ে ওঠেন গ্রুপ অব কোম্পানির এমডি। কমপক্ষে ১২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা তার।

আরো বলা হয়, জাপান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে সঙ্গে নিয়ে আসেন বিপুল অর্থ। সেই অর্থ ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নিয়ে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েন। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের প্রভাবশালী কয়েক নেতার সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে তার পক্ষে কাজ করছেন বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এক এমডিসহ কয়েক কর্মকর্তা বিপুল অর্থের বিনিময়ে মাহিনকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা দিয়েছেন।

দুদকের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি রহস্যজনকভাবে মাহিনকে এক দফায় ৫ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাণিজ্যিক গৃহনির্মাণ ঋণ দেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের কোনোরূপ নিয়মনীতি অনুসরণ করেননি তিনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং লন্ডনে মাহিনের একাধিক ফ্ল্যাট থাকার তথ্যও পেয়েছে দুদকে।

মাহিনের মালিকানাধীন ‘সুইস কোয়ালিটি প্যারের বিডি লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের ফেসভ্যালু ৩০ কোটি টাকা হলেও ২০১৩ সালে ১২০ কোটি ইউরো মূল্য ধরে তাকে ঋণ দেয়া হয়। তার মালিকানাধীন তানাকা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাইটাস স্পিনিং মিলসকে অগ্রণী ব্যাংকের শিল্পব্যাংক করপোরেট শাখা থেকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। এই গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান ‘মারহাবা সিনথেটিক মিলস লিমিটেড’সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়া হয়।

আরো জানা গেছে, গাজীপুরে তানাকা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের বড় শেয়ারের ও সেগুনবাগিচায় স্ত্রীর বড় ভাই আখতারের নামে কিনেছেন ফ্ল্যাট। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ধানমণ্ডির মতো অভিজাত এলাকায় মাহিনের নামে-বেনামে অন্তত সাতটি বাড়ি রয়েছে। কেরানীগঞ্জে আগানগরসহ বিভিন্ন এলাকায় তিনটি মার্কেট ও কেরানীগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরে দুই হাজার শতাংশের বেশি জমিরও মালিক এই মাহিন।

গাজীপুরে বেনামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মাইটাস স্পিনিং মিল’। কাগজে-কলমে সেটি তানাকা গ্রুপের। তবে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দেখানো হয়েছে কেরানীগঞ্জের জনৈক বিএনপির নেতার স্ত্রী ও নিকাত্মীয়ের নামে। তবে ওই নেতা এ বিষয়ে বলেন, ‘মাইটাস স্পিনিং মিলের নামে আমার বা আমার স্ত্রীর কোনো ফ্যাক্টরি নেই।’

কেরানীগঞ্জের তানাকা পেট্রলপাম্প ও আগানগরের তানাকা শপিং কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠান দুটির বেনামে মালিক ওই বিএনপি নেতা এবং মাহিন। সাভারে পাঁচতলা বাড়িতে অনিক জেনারেল হাসপাতাল নামে একটি হাসপাতাল রয়েছে মাহিনের। এ হাসপাতালের নামে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৬০ কোটি টাকা।

-ডিকে

FacebookTwitter