স্বাস্থ্যঃ
সারা বিশ্বের প্রায় ১১৬ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখেন। যাদের রোজা রাখার সামর্থ্য আছে তাদের জন্য ডায়াবেটিস এমন কোনো বাধা নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীরা রোজা রাখলে খুব কমই জটিলতার সন্মুখীন হন। বেশীরভাগ ডায়াবেটিস রোগীই রোজা রাখতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতির। রমজানের কমপক্ষে ৩ মাস পূর্বে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুতি নেয়া দরকার। রোজা রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত রোগীর নিজস্ব, ডাক্তারের ভূমিকা এখানে শুধু পরামর্শক হিসেবে কাজ করা।
ডাক্তার রোগের ধরণ, ইতিহাস ও প্রয়োজনীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষে রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ কি না তা রোগীকে জানাবেন এবং রোগী রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা যেন নিরাপদে রাখতে পারেন সেইমত তার জীবনযাত্রা, ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসা সম্পর্কিত বিষয়াদি নির্ধারণ করে দিবেন। অনেক বেশী ঝুঁকি আছে জেনেও অনেক রোগীই রোজার ইবাদত বাদ দিতে চান না।
আশার কথা এটাই যে আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি সহজে এবং নিরাপদে রোজা রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রোজা রাখলে রক্তে সুগার বেশী কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) সহ অন্যান্য জটিলতা রমজানের পূর্বের চেয়েও অনেক কম হয়। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া রোজা রাখলে বেশ কিছু জটিলতার উদ্ভব হতে পারে।
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনযাত্রার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন- ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান- ডা. এ.বি.এম. কামরুল হাসান। তথ্য সংগ্রহে ছিলেন- মুছা মল্লিক।
রোজার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
● গ্লুকোজ কমায়, ● ওজন কমায়, ● রক্তের খারাপ চর্বি কমায়, ● ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা কমায়, ● রক্তচাপ কমায়, ● হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, ● প্রদাহ কমায়, ● পরিপাকতন্ত্র ও লিভার ভাল রাখে, ● মস্তিষ্ক ও নার্ভের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, ● ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
রোজা রাখলে ডায়াবেটিসের রোগীরা যেসব সমস্যায় পড়তে পারেন
● হাইপোগ্লাইসেমিয়া: গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া (৩.৯ মিলিমোল/লিটার)।
● হাইপারগ্লাইসেমিয়া: গ্লুকোজের মাত্রা বেশি হওয়া, কিটোএসিডোসিস ও হাইপারঅসমোলার স্টেট।
● রক্তের মধ্যে ফ্যাট বা চর্বি অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া।
● ওজন বেড়ে যাওয়া: অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ, কম চলাফেরা ও শারীরিক পরিশ্রম করার কারণে।
● পানিশূন্যতা, রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া।
● শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের (যেমন-হার্ট, কিডনি, লিভার) কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া।
ডাক্তারের করণীয়
● ঝুঁকি নির্ধারণ, ● রোজায় ডায়াবেটিস সম্পর্কিত শিক্ষা, ● ঔষধ পূনঃব্যবস্থাপনা, ● ফলো-আপ
ডায়াবেটিসের রোগী, যাদের রোজা রাখা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
● বিগত ৩ মাসের মধ্যে গ্লুকোজ অতিরিক্ত কমে গিয়েছিল।
● ৩ মাসের মধ্যে কিটোএডোসিস / হাইপার অসমোলার স্টেট।
● ঘনঘন গ্লুকোজ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়।
● গ্লুকোজ অতিরিক্ত কমে গেলেও কোনো উপসর্গ হয় না।
● অনিয়ন্ত্রিত টাইপ ১ ডায়াবেটিস।
● হঠাৎ গুরুতর যে কোন অসুস্থতা।
● গর্ভবতী মা যাদের আগে থেকেই টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে, অথবা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছে এবং ইনসুলিন / সালফোনাইলইউরিয়া ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন।
● দীর্ঘমেয়াদি ডায়ালাইসিসের রোগী অথবা কিডনী রোগ খুবই গুরুতর পর্যায়ে আছে এমন রোগী (স্টেজ ৪ ও ৫)।
● গুরুতর রক্তনালীর রোগ, যেমন, হার্ট-অ্যাটাক, স্ট্রোক।
● ভগ্ন স্বাস্থ্যের অতিবৃদ্ধ রোগী।
উপরোক্ত দুই গ্রুপের রোগী রোজা রাখতে চাইলে নীচের পরামর্শ ও শর্ত মানতে হবে
● ডায়াবেটিসে রোজা রাখা সম্পর্কে কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণ লাভ করতে হবে।
● একটি যোগ্য ডায়াবেটিস টীমের তত্বাবধানে থাকতে হবে।
● গ্লুকোমিটারে নিয়মিত রক্তের সুগার পরিমাপ করতে হবে।
● রোজা শুরুর আগে এবং রোজার সময় রক্তের সুগারের পরিমাপ অনুযায়ী নির্দেশনামত ওষুধ সমন্বয় করতে হবে।
● রক্তের সুগারের অতি-স্বল্পতা বা অতি-আধিক্যে রোজা ভেঙ্গে ফেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
● বারবার রক্তের সুগারের অতি-স্বল্পতা বা অতি-আধিক্য হলে অথবা রোজা অবস্থায় অন্যান্য রোগ। বেড়ে গেলে পরবর্তী রোজা আর না রাখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ডায়াবেটিসের রোগী, যাদের রোজা রাখা কম বা মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণঃ যাদের ডায়বেটিস টাইপ-২ ধরণের এবং শুধু জীবনযাত্রার পরিবর্তন বা নীচে উল্লেখিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আছে-
● মেটফরমিন
● একারবোজ বা ভগ্লিবোজ
● পায়োগ্লিটাজোন
● গ্লিমেপিরাইড বা গ্লিক্লাজাইড
● গ্লিপ্টিন বা লিরাগ্লুটাইড
● এমপাগ্লিফ্লোজিন, ডাপাগ্লিফ্লোজিন, কানাগ্লিফোজিন
● ইনসুলিন ডিগ্লুডেগ, গ্লারজিন, ডিটিমির।
এই গ্রুপের রোগী রোজা রাখতে চাইলে নীচের পরামর্শ ও শর্ত মানতে হবে
● ডায়াবেটিসে রোজা রাখা সম্পর্কে কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণ লাভ করতে হবে
● গ্লুকোমিটারে নিয়মিত রক্তের সুগার পরিমাপ করতে হবে
● রোজা শুরুর আগে এবং রোজার সময় রক্তের সুগারের পরিমাপ অনুযায়ী নির্দেশনামত ওষুধ সমন্বয় করতে হবে।
ঝুঁকি নির্ধারণের জন্য ওয়ার্ক-আপঃ রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত ইতিহাস এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা
● রোগীর ডায়াবেটিসের ধরণ (টাইপ ১, ২ বা অন্য কোন ধরণ)
● মহিলা রোগী হলে গর্ভবতী কি না
● খাদ্যাভাস, কাজের ধরণ
● কী ধরণের চিকিৎসা পাচ্ছেনঃ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও শরীরচর্চা, মুখে খাবার ঔষধ (কোন গ্রুপের), ইনসুলিন (কোন ইনসুলিন, কতবার)
● ব্লাড সুগারের রেকর্ডঃ রোগী বাড়িতে নিজে সুগার নিয়মিত মেপে থাকলে সেই রেকর্ড, ল্যাবের পরীক্ষার রিপোর্ট, হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা অতিরিক্ত হাইপারগ্লাইসেমিয়ার ইতিহাস, হাসপাতালে ভর্তি এবং চিকিতসার ইতিহাস, কিটোএসিডোসিসের ইতিহাস
● ডায়াবেটিস জনিত জটিলতাঃ কিডনী, হার্ট, ব্রেনস্ট্রোক, অন্যান্য
● অন্যান্য রোগঃ মস্তিষ্ক, লিভার, ফুসফুস, ও খাদ্যনালির রোগ, পেপটিক আলসার, মানসিক রোগ
● অন্যান্য রোগের জন্য প্রতিদিন সেব্য ওষুধ
● আগের রমজানের সময় বা অন্য কোন সময় রোজা রেখে থাকলে সেই সময়কালের অভিজ্ঞতা
● যে সকল পরীক্ষা করা যেতে পারেঃ Blood Glucose, HbA1c, Serum Creatinine, SGPT, Urine R/E, এবং প্রয়োজনে অন্যান্য পরীক্ষাদি।
রিপোর্ট- সংগৃহীত
–