জুয়ার আইনকে আধুনিক করার চিন্তা হচ্ছে

অনলাইনঃ
অবৈধ হাউজি ও জুয়া খেলা প্রতিরোধে ১৫০ বছরের পুরনো আইনকে যুগোপযোগী করার চিন্তা চলছে নীতিনির্ধারক মহলে।

এ লক্ষ্যে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে। গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ক্যাসিনো-সংশ্নিষ্ট লোকজন ও জুয়াড়িদের জুয়া আইনের আওতায় আনার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি সাজা বাড়ানোর বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮৬৭ সালের জুয়া আইন দিয়ে ২০১৯ সালের ক্যাসিনো অপরাধের বিচার করা সম্ভব নয়। আইনটি পরিবর্তন বা সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি প্রচলিত অন্য আইনগুলোর সহায়তা নিয়ে এসব জুয়াড়ি ও জুয়া-সংশ্নিষ্টকে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, যারা জুয়া খেলছে তারা ক্রিমিনাল মোটিভের ভেতর ঢুকে গেছে।

তাদের আইনের আওতায় আনতে হলে ১৫০ বছরের পুরনো আইন দিয়ে কাজ হবে না। আর জুয়া খেলা বন্ধও করা যাবে না। তাই অবশ্যই নতুন কিছু করার চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে পুরনো আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্রকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় (বাংলাদেশের মধ্যে) যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণের মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী বা ব্যবহারকারী হিসেবে অনুরূপ স্থানকে সাধারণ জুয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে এবং যে কেউ এসব স্থানকে ব্যবহারের দায়িত্বে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন অথবা যে কোনো সাহায্য করলে এবং ওইসব স্থানে যে কেউ জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে অর্থ দিলে সে অভিযুক্ত হিসেবে অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা এবং অনূর্ধ্ব তিন মাস পর্যন্ত কারাদ অথবা উভয়দে দ নীয় হবে।

ক্যাসিনো বন্ধ ও সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও এসবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের প্রচলিত জুয়া আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেশে ক্যাসিনো চালালে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কোনো আইন নেই। মানি লন্ডারিংসহ অন্য অপরাধ গণ্য না করা হলে এবং নতুন আইন করা না হলে ‘ক্যাসিনো কাে ‘ জড়িতদের বিরুদ্ধে ১৮৬৭ সালের ‘প্রকাশ্যে জুয়া আইনে’ মামলা হতে পারে।

ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুতে জারি করা ১৫২ বছরের এ আইনটি এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। এ আইনে জুয়া খেলার অপরাধ সর্বোচ্চ ২০০ টাকা জরিমানা এবং তিন মাসের কারাদ। ক্ষেত্রবিশেষে উভয় দ একত্রে কার্যকর করার বিধানও রাখা হয়েছে আইনটিতে। কিন্তু তারপরও এই শাস্তি হাস্যকর ও যথাযথ নয়। যাদের কোটি কোটি টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়েছে কিংবা যাদের কাছে অর্থসহ শত শত ভরি স্বর্ণ পাওয়া গেছে,আইনটিতে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে এই সাধারণ শাস্তি। নাইট ক্লাব বা ক্যাসিনো বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনও নেই।

এদিকে বর্তমানে দেশে প্রচলিত পাবলিক গেমব্লিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ আইনটি রাজধানীতে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে ইহা প্রযোজ্য হইবে’।

অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর ৯২ ধারায় প্রকাশ্যে জুয়া খেলার জন্য মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

এদিকে, হাউজিসহ বিভিন্ন জুয়া খেলা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তাই ব্রিটিশ আমলেই জুয়াড়িদের ভয় দেখাতে এবং সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে ১৮৬৭ সালে প্রকাশ্যে জুয়া আইন করা হয়েছিল। তারপর এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পেরুলেও এ আইনটি আর সংশোধন হয়নি। ফলে ব্রিটিশ আমলে নির্ধারিত জুয়াখেলার অপরাধে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা জরিমানা এবং তিন মাসের কারাদ রয়েই গেছে। সরকারের পর সরকার বদলালেও আইন সংস্কার করা হয়নি।

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করা দরকার। পাশাপাশি অপরাধের সাজাও বাড়াতে হবে। কেবল জুয়া বন্ধের পুরনো আইন থাকলেও কার্যত তা খুব দুর্বল। তাছাড়া ক্যাসিনো বন্ধেও কোনো আইন নেই। অথচ যাদের কাছ থেকে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ, নগদ টাকা-গহনা পাওয়া যাচ্ছে তাদের দুদক তলব করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা পুরনো আইন সংশোধন করলে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা যাবে কি-না তা আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং বিভাগ বলতে পারবে।

ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এখন যারা অভিযুক্ত হচ্ছেন, তাদের আগে শোকজ করতে হবে, নোটিশ করতে হবে। সন্তোষজনক জবাব না পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু হঠাৎ করে আইন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। কাউকে কোনো কাজের জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হলে তাকে আগে সুযোগ দিতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, দেশে জুয়া প্রতিরোধের আইনটি অত্যন্ত দুর্বল। তবে নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নেই। পুরনো আইন সংশোধন করলেই অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া বলেন, জুয়া খেলা শুধু একটি অপরাধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও অনেক অপরাধ। তাই অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধের চিন্তা থেকেই জুয়া খেলা নজরদারিতে আনা ও বন্ধ করা প্রয়োজন।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ক্যাসিনো বা জুয়া খেলার মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। এর সঙ্গে রাজস্ব বিভাগকে যুক্ত করতে হবে এবং সার্বিক বিবেচনায় নতুন আইনের দরকার রয়েছে। এ আইনে জুয়ার সঙ্গে জড়িতদের দায়বদ্ধ করার বিধান রাখতে হবে।

দুর্নীতিবিরোধী সাম্প্রতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে র‌্যাব গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রথম অভিযান চালায়। এদিন ক্লাবটির কর্ণধার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। একই দিন মতিঝিলে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবেও অভিযান চালানো হয়।

এসব অভিযানে জুয়া-ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম, টাকা জব্দের পাশাপাশি ১৪২ জনকে আটক করা হয়। যুবলীগ নেতা খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রা পাচার আইনে মামলা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় গত রোববার পুলিশ মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ এবং দিলকুশা ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জুয়ার সামগ্রী জব্দ করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানে প্রতিদিনই ক্যাসিনোর সন্ধান মিলছে দেশের বিভিন্ন ক্লাবে। অব্যাহত রয়েছে গ্রেফতার কার্যক্রম।

-কেএম

FacebookTwitter