শিশির মোজাম্মেলঃ
প্রকৃত স্পষ্টবাদী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ওষুধ নীতি প্রনেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা গেছেন।
মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাত সোয়া ১১ টায় ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন মোস্তাফী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে, গত ৫ এপ্রিল গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ডা. জাফরুল্লাহকে রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় কয়েকদিন ধরে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ডা. জাফরুল্লাহ বহু বছর ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর লিভারের সমস্যাও দেখা দেয় তার। এ ছাড়া তিনি অপুষ্টিসহ সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন ডা. জাফরুল্লাহ। বাবা-মায়ের দশ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন ভাস্কুলার সার্জন। তিনি মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।
ডা. জাফরুল্লাহ ভারতের আগরতলায় গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তা পরিচালনা করেন। ১৯৮২ সালে তার উদ্যোগে জাতীয় ওষুধ নীতি ঘোষণা করা হয়।
এ ছাড়া তিনি শিক্ষা, চিকিৎসা, গরিবদের সাহায্যের জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করে মানবতার ফেরিওয়ালা হয়েছেন।
সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পাকিস্তানি পাসপোর্ট পুড়িয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে সময় তিনি রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস এ এফআরসিএস অধ্যয়নরত ছিলেন।
পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার কথা জানতে পেরে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন ডা. জাফরুল্লাহ। সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। গড়ে তোলেন ফিল্ড হাসপাতাল।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে লন্ডনে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। এপ্রিলে হাইড পার্কের সমাবেশে ডা. জাফরুল্লাহ নিজের পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিড়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। তখন তিনি রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক।
বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা। নানা নাটকীয়তার পর ফিরে আসেন ভারতে।
‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘চেনা হয়ে উঠেছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এমএ মোবিন।
এরা দুজনে ইংল্যান্ডে এফআরসিএস পড়ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে লন্ডনে চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন এফআরসিএস পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ বাকী, তখনই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু।
ছেলে দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নিলো, পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করল, ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লিগামী প্লেনে চড়ে বসল।
উদ্দেশ্য ওখান থেকে কলকাতা হয়ে রণাঙ্গনে যাওয়া। প্লেনটা ছিল সিরিয়ান এয়ারলাইন্স-এর। দামাস্কাসে পাঁচ ঘণ্টা প্লেন লেট, সবযাত্রী নেমেছে।
ওরা দুইজন আর প্লেন থেকে নামে না। ভাগ্যিস নামেনি। ‘পলাতক পাকিস্তানি দুই নাগরিককে’ গ্রেপ্তার করার জন্য এয়ারপোর্টে এক পাকিস্তানি কর্নেল উপস্থিত ছিল।
তিনি লিখেছেন, প্লেনের মধ্য থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না, কারণ প্লেন হলো ইন্টারন্যাশনাল জোন। দামাস্কাসে সিরিয়ান এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা ওদের দুইজনকে জানিয়েছিল যে, ওদের জন্যই প্লেন পাঁচ ঘণ্টা লেট।
এমনিভাবে ওরা বিপদের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষে সেক্টর টু রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হয়।’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাতেই জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণীত হয়। সেই কারণেই প্রায় ২০০ দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। এখন দেশের চাহিদার ৯৬ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে।
-জেএফ