করোনা নিয়ে ভারতে সংঘর্ষ, শত শত মানুষ আশ্রয় শিবিরে

আন্তর্জাতিকঃ
ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ থামে গতকাল বৃহস্পতিবার।

দেশটির পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায় এই সংঘর্ষ হয়। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরেই আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এতে করে কয়েকশো মানুষ আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, ঘরের সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে। এমন খবর প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

হুগলী জেলার চন্দননগরের পাশে তেলেনিপাড়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি শান্ত হলেও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় তারা এখন পর্যন্ত ১২৯ কে গ্রেপ্তার করেছে। আর আটক করেছেন আরো ২১ জনকে।

এই দাঙ্গায় চটকল এলাকার কয়েকশো ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে। এতে করে বহু মানুষ এখন স্থানীয় স্কুল এবং অনেকেই আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই দাঙ্গার সাক্ষী স্থানীয় বাসিন্দা আফতাব সুলতান। তার বাড়ির কয়েকটি ঘর পর থেকেই শুরু হয়েছিল বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। সেই সব পোড়া ঘর গিয়েছিলেন তিনি।

আফতাব সুলতান বলেন, ‘ঈদগাহ ময়দানের কাছে আমি যেখানে থাকি, তার পাঁচটি বাড়ি ছেড়ে পরপর তিনটি বাড়ি একদম পুড়ে গেছে। সবগুলোই মুসলমানদের ঘর। দিল্লির দাঙ্গায় যেসব জিনিস ব্যবহার করা হয়েছিল বলে টিভির খবরে দেখেছি। যেমন- অ্যাসিড, পেট্রল আর গ্যাস সিলিন্ডার। এখানেও সেগুলোর ব্যবহারের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘কোনো বাড়িতে ঈদের পরে বিয়ের ঠিক হয়ে আছে। তাই গয়না রাখা ছিল, সব পুড়ে গেছে। জমিয়ে রাখা টাকার গোছার পোড়া অংশও দেখেছি। কোনো কিছুই বাকি নেই ওইসব ঘরে।’

হিন্দু এলাকার মধ্যে যেমন মুসলমানদের বাড়ি পুড়েছে, তেমনই মুসলমান প্রধান এলাকাতে হিন্দুদের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে। তবে ভুক্তভোগী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

কারা ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছে- এর জবাবে সুলতান বলেন, ‘মুসলমান প্রধান এলাকায় যে ঘরগুলোতে হিন্দুরা থাকত, সেখানে মুসলমানরা জ্বালিয়েছে। আবার একই ভাবে হিন্দু প্রধান এলাকায় মুসলমানদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে হিন্দুরা। আমি নিজে মুসলমান হলেও এই তথ্য স্বীকার করতে দ্বিধা করব না। দাঙ্গা পরিস্থিতিতে যার যেখানে শক্তি বেশি, তারাই দুর্বলের ওপরে আক্রমণ করে।

ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা মুহম্মদ আইনুল হক। একটি দোকানে কাজ করতেন, কিন্তু শারীরিক সমস্যার জন্য সাত মাস কোনো আয় নেই। বস্তি এলাকা থেকে উঠে এসেছিলেন একটি সস্তার ফ্ল্যাটে, শান্তিতে থাকার জন্য। কিন্তু সেই ফ্ল্যাট এখন বিধ্বস্ত, আশ্রয় নিয়েছেন মেয়ের বাড়িতে।

আইনুল হক বলেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাটে পুলিশ ঢোকে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে। মেইন গেট ভেঙে তারা প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে ঢুকছিল আর বলছিল আপনারা যদি না বেরিয়ে আসেন তাহলে দরজা ভেঙে ঢুকে খুব মারবো। তাই করছিল ওরা। তালা ভেঙে যাকে পেয়েছে, তাকে মেরেছে। তারপর ঘরে ঢুকে যা যা জিনিষ ছিল- টিভি, ফ্রিজ, আলমারি সব তছনছ করেছে। আবার সব নতুন করে গড়তে হবে আমাকে।’ পুলিশ তাদের ঘরে ঘরে ঢুকে মারধর, ভাঙচুর করেছে বলেও অভিযোগ করেন আইনুল হক।

এ বিষয়ে চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবীর জানান, ‘কাউকে গ্রেপ্তার করতে গেলে দরজা যদি না খোলা হয়, সেক্ষেত্রে দরজার ছিটকিনি বা তালা ভাঙ্গার প্রয়োজনে পুলিশ দরজা ভাঙ্গতেই পারে। তবে তেলেনিপাড়া থেকে ঘরে ঢুকে ভাঙচুর করেছে পুলিশ, এরকম কোনো অভিযোগ আমি পাই নি। কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস পরীক্ষায় যাদের ফলাফল পজিটিভ এসেছে, তাদের কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে তেলেনিপাড়ায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়। গত রবিবার প্রথম উত্তেজনা তৈরি হলেও পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে নতুন করে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

স্থানীয় সূত্র মতে, কয়েকদিন আগে করোনা পরীক্ষার একটি শিবির করা হয়েছিল তেলেনিপাড়া এলাকায়। পরীক্ষায় প্রথমে একজন আর তারপরে আরো কয়েকজনের পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ঘটনাচক্রে তারা সকলেই মুসলমান।

এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘ক্যাম্পটা মুসলমান প্রধান এলাকায় হয়েছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই পজিটিভ এলে মুসলমানদেরই হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে হিন্দুদের একাংশ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে। মুসলমানরাই করোনা ছড়াচ্ছে বলে ইয়ারকিও করা হয়।’

তেলেনিপাড়া থেকে পাশের ভদ্রেশ্বরেও এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যেই মুসলিম প্রধান এলাকাটি ব্যারিকেড করে দেয়া হয়, যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। এর পরেই উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। ব্যাপক বোমাবাজি ও দোকান-বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গুজব বন্ধ করতে ওই অঞ্চলে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।

-ডিকে

FacebookTwitter