“এক জোড়া সোনার দুল”

মনিরা সুলতানা পাপড়ি

মেয়েরা আঁচল বেঁধে রাঁধে, চুল বাঁধে, ঘর সামলায়, বাইরে থেকে এসে স্বামী, ছেলে-মেয়ের ছুঁড়ে ফেলা মোজা গুলো কুড়িয়ে ওয়াশিং ব্যাগে রাখে নয়তো সাথে সাথে কেচে দেয়।

ঘরে কখন চা-পাতা ফুরোলো সেটাও যেমন খেয়াল রাখে, আবার অফিসে বসের চায়ের কাপের চা ঠান্ডা হবার আগেই তার সামনে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন টা রেডি করে দেয়। দরকার ছিলো না সব কিছু এতো পারফেক্টলি করার। কেউ করে না। কিন্তু স্মার্ট প্যাট্রিয়ার্কাল আইডিয়োলজি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে পারফেক্ট তাদের হতেই হবে। মেয়েদের নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা। পারফেক্টলি করতে হবে।

কিন্তু কেন এই রেইস? কার জন্য? কে পারফেক্ট? কেউ যদি পারফেক্ট না হয়, মেয়েদের কেন হতে হবে?

কেউ জিজ্ঞেস করেছে, এই মেয়ে তোমার পার্স টা কেমন রঙ জ্বলে গেছে, একটা নতুন নাও না কেন? নীল শাড়ীতে কি মায়াবী লাগে তোমায়, না নীল কাতান না একটা নীল টাই ডাই এর নরম সুতী শাড়ী কিনে এনে কেউ রাখে বিছানায়। শাওয়ার সেরে এসে পরো তো, একটু নীল কাজল দিয়ো চোখের কোল টায়!! মেয়েটা যদি অনেক ভালো স্যালারীও পায়, কিন্তু তবু এই ছোট্ট সাদাসিধে উপহার গুলো যে তাদের কি ভালো লাগে ছেলেরা যদি জানতো।

আর যে মেয়েটার নিজের কোন আর্নিং সোর্স নেই সে তো চাতকের মতো চেয়ে থাকে স্বামীর ওয়ালেট এর দিকে আর তার একটু মনযোগের দিকে। কতো মেয়ের একটা হেয়ার কাট দরকার, একটা নতুন জুতো দরকার, একটা ভালো পারফিউম দরকার অথচ, স্বামীর তহবিল থেকে বিল পাশ হচ্ছে না। মজার মজার কলিজা ভূনা, কই এর দোপেয়াজার বিল পাশ হচ্ছে, কিন্তু এই প্রফিট বিহীন খাতের জন্য বিল পাশ হচ্ছে না।
যারা যৌথ পরিবারে থাকে তাদের তো আবার শাশুড়ী, ননদ এর কাছ থেকেও অনুমোদন লাগে। সব জায়গা থেকে এপ্রুভাল এলে তবে না প্রজেক্ট পাশ হবে।

“মেয়ে” বাবা-মা লেখাপড়া শেখায় নি? চাকরির এপ্লিকেশন করতে জানো না? সরকারি আমলা না হতে পারো, কিন্তু ঠিকঠাক একটা প্রাইভেট জব ঠিকই জুটিয়ে নিতে পারবে।

কারোর মুখের একটু করুনার হাসির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। একটা ছোট্ট সোনার দুল এর শখ,বৃটিশ আমলের ব্যুরোক্রেসির মধ্যে পড়ে মাসের পর মাস টেবিলের কোনায় রাখা পেন্ডিং বিলের ফাইলের স্তুপে ধুলোর আস্তরে হারিয়ে যাবে না।

জগৎ উদ্ধার এর দায়িত্ব তোমাকে কেউ দেয় নি। পারফেক্ট হবার এই দৌড়ে তোমাকে কেউ মেডেল দেবে না। যা করতে ভালো লাগে, যা বলতে ভালো লাগে সেই কাজ করতে এবং বলতে কি লাগে জানো? একটা কন্ঠ লাগে। আর আমাদের দেশে একটা মেয়ের সেই কন্ঠ শুধু ভোকাল কর্ড থেকে আসে না, আসে মেয়েটার নিজের আর্থিক স্বাধীনতা থেকে, তার ব্যক্তিত্বের ধার থেকে।

গলায় শুধু একটা সোনার চেন আর কানে শুধু কুন্দনের দুল পরার শখ হলেই হবে না মেয়ে। গলায় একটা দৃঢ় কন্ঠ লাগবে, কানে লাগবে সেন্সিটিভিটি যাতে তোমার ব্যক্তিত্বকে কেউ খাটো করে কথা বললে কানে গরম সীসা ঢেলে দেয়ার মতো যন্ত্রণা হয় তোমার। আর নিজের পকেট খরচ, নিজের একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন, নিজের পছন্দের সুতি শাড়ি বা একটা কানের দুল এর জন্য যেন কারোর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে না হয় সেই সক্ষমতা থাকা লাগবে।

দেখবে তখন তোমাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য লোকে উন্মুখ হয়ে থাকবে। তখন তোমাকে খাটো করে কথা বলতে হাজার বার ভাববে মানুষ। তোমার মতামতের তখন অনেক দাম। বাড়ির কোন তলায় কোন ফার্নিচার আসবে সেটা নিয়ে তোমার মতামত চাইবে লোকে।

সিদ্ধান্ত তোমার, ঘরের ফার্নিচার কোনটা কোথায় বসবে সেটা তুমি ডিসাইড করবে নাকি নিজেই একটা শাল কাঠের ফার্নিচার হয়ে ধুলোর আস্তরে অনাদরে অবহেলায় বছরের পর বছর ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকবে, সেই স্বিদ্ধান্ত একান্তই তোমার।

-শিশির

FacebookTwitter