প্রকৌশলী মোঃগোলাম হোসেন ফারহানঃ
সরবরাহের শীর্ষে শাহ সিমেন্ট জোট, ভালো করেছে ফ্রেশ জোট ও ক্রাউন সিমেন্ট আর বড়দের মধ্যে পিছিয়েছে বসুন্ধরা ও লাফার্জহোলসিম জোট বিশ্বে চলমান অতিমারী করোনার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ বাংলাদেশ দেখেছে ২০২১ সালে।
এ বছর আমরা হারিয়েছি প্রায় ২০৫১৩ জন মানুষ ছিল তালিকাভুক্ত। আগের বছরে অর্থাৎ ২০২০ এ যেখানে তালিকাভুক্ত এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫৫৯ জন। অর্থাৎ প্রায় ৩ গুন্ বেশি মানুষ আমরা এই সময়ে হারিয়েছি।
স্বাভাবিক ভাবেই সকলের আশঙ্কা অনুসারে ব্যাবসা-বাণিজ্য কম হওয়ার কথা ছিল,কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই বছরেও বাংলাদেশিরা তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চালিয়ে গেছে এবং তারই ফল স্বরূপ এই বছর সিমেন্ট সরবরাহের নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ।
২০২১ এ মোট সিমেন্টের সরবরাহ ছিল ৩৯.৩৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন (প্রায়) ,যেখানে আগের বছরে এই সরবরাহ হয়েছিল ৩৩.৯২ মিলিয়ন মেট্রিক টন (প্রায়)। অর্থাৎ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৬.০৬ শতাংশ।
অকল্পনীয় হলেও সত্য যে, ২০২১ এ অর্থাৎ করণের প্রাদুর্ভাবের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থের বছরেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে। এবং এটি সম্ভব হয়েছে অদম্য বাংলাদেশের উন্নয়নমুখী যাত্রার জন্য।
বাজারের তথ্যের ভিত্তিতে তুলনামূলক চিত্রের একটি ছক নিচে দেয়া হলো:
আবুলখায়ের গ্রূপের শাহ সিমেন্ট তাদের নতুন ব্র্যান্ড আশা সিমেন্টকে সাথে নিয়ে ২০২১এ বাজারের সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট সরবরাহ করে যথারীতি ১ নাম্বার অবস্থানে আছে। তারা গতবছর প্রায় ৫.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন সিমেন্ট ডেলিভারি দিয়েছে যা কিনা মোট চাহিদার ১৪.৩৩% …
দ্বিত্বীয় অবস্থানে উঠে এসেছে মেঘনা গ্রূপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ ফ্রেশ সিমেন্ট ও তাদের শাখা ব্র্যান্ড মেঘনাসিম ডিলাক্স। এই জোটের গত বছরের মার্কেট শেয়ার ১০.১০% , যা কিনা ২০২০ এও ছিল ৮.৬৫% এবং তখন তাদের পজিশন ছিল ৩ নাম্বার।
এইদিকে বসুন্ধরা গ্রূপের বসুন্ধরা ও কিং ব্র্যান্ড সিমেন্টের জোট আগের বছরের থেকে ১.৭১% মার্কেট শেয়ার হারিয়ে নেমে এসেছে তালিকার ৩ নাম্বারে।
চমৎকার একটি বছর পার করেছে এম,আই সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের ক্রাউন সিমেন্ট। ০.৪২% মার্কেট শেয়ার বেশি দখল করে তারা আগের বছরের ৬ নাম্বার পজিশন থেকে ৪ নাম্বার পজিশনে উঠে এসেছে।
সেভেন রিং সিমেন্ট ০.১০% মার্কেট শেয়ার হারালেও ২০২১ শেষে ৫ নাম্বার অবস্থানটি ধরে রাখতে পেরেছে।
লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ দুটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান একত্রীকরণ করার পরে ২০২০ এ ভালো করে,৪ অবস্থানে চলে গেলেও, ২০২১ এ এসে ০.৬৩% মার্কেট শেয়ার হারিয়ে তারা এবার বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ে ৬ নাম্বার অবস্থানে চলে এসেছে।
এইদিকে আরেকটি বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ বাংলাদেশ তাদের স্ক্যান ও রুবি ব্র্যান্ড নিয়ে ২০২১ এ আগের বছরের তুলোনায় ০.৯৬% বেশি মার্কেট শেয়ার দখল করে ৭ নাম্বার অবস্থানে চলে এসেছে।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের মার্কেট শেয়ার ০.১৫% বাড়লেও তারা বাজারের অবস্থানে এ ধাপ পিছিয়ে ৮ নাম্বারে অবস্থান করছে।
০.৪১% মার্কেট শেয়ার বাড়িয়েও আকিজ সিমেন্ট তালিকার ৯ নাম্বারেই আছে। আবার , ০.০৪% মার্কেট শেয়ার হারিয়েও বেঙ্গল সিমেন্ট একই ১০ নাম্বার অবস্থানেই আছে।
আনোয়ার সিমেন্ট তাদের অবস্থান কিছুটা উন্নতি করে ১১ নাম্বারে আসলেও,বিবেচনায় নিতে হবে তারা কিন্তু ০.২২% মার্কেট শেয়ার আগের বছরের তুলনায় হারিয়ে ফেলেছে। একইভাবে, আমান সিমেন্ট ০.১৪% মার্কেট শেয়ার হারিয়েও তালিকায় ১২ নম্বর অবস্থানে উঠে এসেছে।
কনফিডেন্স সিমেন্ট তাদের প্রবল আত্ববিশ্বাসের সাথে ১৬ নাম্বার অবস্থান থেকে ১৩ নাম্বার অবস্থানে চলে এসেছে। তাদের ২০২১ শেষে মার্কেট শেয়ার ২.০৫% ।
০.৩৬% মার্কেট শেয়ার হারিয়ে দুবাই বাংলাদেশ সিমেন্ট লিমিটেড এর ফাইভ রিংস সিমেন্ট ব্র্যান্ড চলে গেছে ১৪ নাম্বার অবস্থানে।অবস্থান হারিয়েছে টাইগার সিমেন্টও , ০.১% মার্কেট শেয়ার কমে গিয়ে তারা চলে গেছে ১৫ নাম্বার অবস্থানে।প্রায় একই অবস্থা ডায়মন্ড সিমেন্টেরও, ০.৩২% মার্কেট শেয়ার হারিয়ে এখন আছে ১৬ নাম্বার অবস্থানে।সেইদিক থেকে কিছুটা ভাগ্যভালো সেনাকল্যাণ সংস্থার এলিফ্যান্ট ব্র্যান্ড সিমেন্টের,০.২১% মার্কেট শেয়ার হারালেও ধরে রাখতে পেরেছে ১৭ নাম্বার অবস্থান।
বছরটা বেশ ভালো গেছে মীর সিমেন্টের, এক লাফে আগের বছরের ২২ নাম্বার অবস্থান থেকে চলে এসেছে ১৮ নাম্বার অবস্থানে। ২০২১ শেষে তাদের মার্কেট শেয়ার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৪৫% ।ইনসি সিমেন্ট , আরও একটি বহুজাতিক কোম্পানি হলেও তাদের মার্কেট শেয়ার খুব বেশি একটা আশার আলো দেখতে পারছেনা। ২০২১ সল্ শেষে তাদের মার্কেট শেয়ার কিছুটা বেড়ে ১.৩৮% হয়েছে এবং অবস্থানও কিছুটা উন্নতি হয়ে ১৯ নাম্বারে চলে আসছে।
বরিশাল ভিত্তিক কোম্পানি অলিম্পিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ এর এংকর ও অলিম্পাস সিমেন্ট তাদের মার্কেট শেয়ার কিছুটা বাড়িয়ে চলে আসছে ২০ নাম্বার অবস্থানে। রয়েল সিমেন্ট ও মেট্রোসেম সিমেন্ট উভয়েই তাদের অবস্থান খুইয়ে ২১ ও ২২ নাম্বার অবস্থানে চলে গিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম সিমেন্ট উৎপাদনকারী হিসেবে লাইসেন্স প্রাপ্ত কোম্পানি ইস্টার্ন সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ এর সেভেন হর্স সিমেন্ট একসময় বাজারে সাত ঘোড়ার মত দ্রুত সরবরাহ করতে পারলেও। এই মুহূর্তে তাদের অবস্থান খুবই নিরাশাজনক। বাজারের ১% এর কম তাদের মার্কেট শেয়ার,এবং ২০২১ এ আগের বছরের থেকে ০.০৮% মার্কেট শেয়ার হারিয়ে কোনমতে বিগত বছরের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
চট্রগ্রাম ভিত্তিক কোম্পানি ,এনজিএস সিমেন্ট ২০২০ সালের তুলনায় একধাপ উন্নতি করে ২০২১ শেষে ২৪ নাম্বার অবস্থানে উঠে এসেছে,আবার এই দিকে একই অঞ্চলের এরামিট সিমেন্ট একধাপ অবস্থান হারিয়ে চলে গিয়েছে ২৫ নাম্বারে।
উপরের প্রথম ২৫টি সিমেন্ট ব্র্যান্ডের বাইরে, এস,আলম সিমেন্ট কিছুটা মার্কেট শেয়ার হারালেও আছে ২৬ নাম্বারেই,দেশবন্ধু সিমেন্ট কিছুটা অবস্থান উন্নতি করে ২৭ নাম্বারে,হিমালয় অবস্থান হারিয়ে ২৮,গাজী ও তাইহিও উভয়েই যথাক্রমে আছে আগের অবস্থানে ২৯ ও ৩০ নাম্বারে,মোস্তফা হাকিম এক ধাপ এগিয়ে ৩১ আর ছাতক সিমেন্ট আরও একধাপ পিছিয়ে ৩২এ। এই ব্র্যান্ড গুলো বাদে আরো কিছু আঞ্চলিক ব্র্যান্ড আছে যাদের মার্কেট শেয়ার যৌথভাবে আগের বছরের থেকে কমে ০.৮৮% এ চলে গিয়েছে।
গত বছর আমার একটি লেখায় আমি বলেছিলাম যে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ছোট কোম্পানিগুলোকে হতে হবে অনেক বেশি কৌশুলী । সেখানে আমি বলেছিলাম ২০২০ প্রথম ১০ টি সিমেন্ট কোম্পানির মার্কেট শেয়ার ছিল ৭৩.০৭% , যা ২০২১ শেষে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫.৩৪% এ।
আশা করা যায়,২০২২ এ সিমেন্টের চাহিদা ৪ কোটি মেট্রিক টনের মাইলফলক ছুঁবে।এখন দেখা যাক, এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটাতে গিয়ে বড় জোট মার্কেট শেয়ারের আরও কত ভাগ দখল করবে, আর এই যুদ্ধে কয়টি ছোট কোম্পানি কোনরূপ নতুন কৌশল ছাড়া নিজেদের অস্তিত্ব টিকে রাখতে পারবে !
-শি