মিলি সুলতানা, কুইন্স, নিউইয়র্ক থেকেঃ

শীতপ্রধান দেশে বসবাস করি, তাই স্বাভাবিকভাবেই শাড়ি খুব কম পরা হয়। কিন্তু শাড়ির প্রতি দুর্দান্ত আকর্ষণ আমার রয়েই গেছে। জামাকাপড়ের যাকাত দিতে হয়। কিন্তু কি করব? কয়লা ধুলে ময়লা তো যায়না!! শাড়ি জমিয়ে স্তুপ বানানোর স্বভাবটা আমার আছে। আমার আম্মার ভাষায় যেটা বাজে স্বভাব এবং মারাত্মক অপচয়ও। আম্মা যখন স্বাভাবিক হুঁশ জ্ঞানে ছিলেন, অপচয়ের বিষয়ে সবচেয়ে জোরালো বকা আমিই খেতাম…..তোর বাবার সীমিত আয় দিয়ে তোদের আট ভাইবোনকে ভাত কাপড় ও শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি কিভাবে? জিন্দেগীতে আমি একটি টাকাও অপচয় করিনি। এক টাকা এক টাকা করে একশো টাকা হয়। একশো টাকা থেকে হাজার হয়, তারপর লাখ টাকা….. ঠিক এভাবে তোদের মানুষ করেছি। আর সেই আমার সন্তান হয়ে তোরা এভাবে অপচয় করছিস? কখনো কখনো আম্মার সাথে চালাকি করতাম। নতুন শাড়ি ভাঁজভুজ করার সময় আম্মা দেখতেন। বলতেন, এটা কবে কিনছিস? আমি মিথ্যে বলতাম, এটা তো আগের শাড়ি। আম্মার চোখ গোয়েন্দাদের মত। মুচকি হেসে বলতেন, তোর পেট থেকে আমি হয়েছি? নাকি আমার পেট থেকে তুই হয়েছিস?? তুই যখন মিথ্যে বলিস তোর চেহারা সাফ সাক্ষী দিয়ে দেয় যে তুই মিথ্যা বলছিস। মিথ্যা কথা বলতে প্র‍্যাকটিস লাগে। তোর সে প্র‍্যাকটিস নাই। আমার আম্মা জ্ঞানী মানুষ। কিন্তু এখন আম্মা অবুঝ শিশু বাচ্চার মত। দিনের পর দিন বিছানায় অসাড় পড়ে আছেন। কঠিন সংগ্রাম করছেন অসুস্থতার সাথে।

আমার আম্মা যখন দাদা দাদীর সংসারে পুত্রবধূ হয়ে আসেন মুরুব্বীরা তাঁর আচার আচরণ দেখে বলেছেন, নতুন বউ’র সাথে ভাগ্যলক্ষ্মী আছে। এই মেয়ে একদিন টিনের ঘরের ভিটায় বিশাল দালানকোঠা তুলবে। সেদিন কেউ কেউ বিদ্রুপ করেছিল ভাগ্যলক্ষ্মী বলাতে, এহহে দালানকোঠা উঠবে? জেগে জেগে খোয়াব দেখে!! আরও কত বিদ্রুপ। কিন্তু আম্মার সাথে যে সৌভাগ্য বয়ে এনেছিলেন তার প্রতিফলন বাস্তবে ঠিকই ঘটেছে। আমার দাদা দাদীর টিনের ঘরের ভিটায় সুবিশাল অট্টালিকা উঠেছে। যারা বিদ্রুপ করেছিল তাদের জিহবা সম্ভবত দাঁতের পাটির নিচে কাটা গেছে। গত চার বছর থেকে আম্মা আর নিউইয়র্ক আসতে পারেননি। এখন কেউ আমাকে শাড়ি কাপড় নিয়ে বকতে আসেনা। সঞ্চয় করার পরামর্শ দেয়না। জিজ্ঞেস করেনা, আজ কি রান্না করেছি, কি দিয়ে ভাত খেয়েছি, এতো শুকিয়ে গিয়েছি কেন? পদে পদে বুঝতে পারি পৃথিবীতে মায়ের মত স্নেহ মমতা আর কেউই দেখাতে পারেনি। কোনদিন পারবেও না।

এবার যখন আম্মাকে দেখতে দেশে গিয়েছিলাম, আম্মা তার সন্তানদের তেমন চিনতে পারেননি। অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়া আম্মাকে দেখে বুকে কষ্টের আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েছি। একদিন দুপুরে ভাইবোনেরা সবাই বাইরে গিয়েছিল। আমি যাইনি, আম্মার সাথেই ছিলাম। আমি মাথার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকবার আম্মা আম্মা বলে ডেকেছি। আম্মা বহু কষ্টে কপালের ভাঁজ উপরে তুলে সাড়া দিলেন। আমাকে শুনতে পাচ্ছেন। বললাম, আম্মা আমি মিলি। আমাকে চিনেন? আমি নিউইয়র্ক থেকে এসেছি আপনাকে দেখতে। ও আম্মা আমার সাথে একটু কথা বলেন…… !! আম্মা কোন রেসপন্স করলেন না। আমি নতুন কিনে আনা বেগুনি রঙের কাতান শাড়ি বের করে আম্মার চোখের সামনে ধরলাম, আহাজারি করলাম….. আম্মা এই দ্যাখেন আমি নতুন শাড়ি কিনেছি…… জানি এই শাড়ি সহজে পরা হবেনা……. তবুও কিনেছি…… আম্মা আমি অপচয় করেছি……. ও আম্মা আমাকে আগের মত একটু বকা দেন না…..বলে আমি জোরে কেঁদে উঠলাম। দেখলাম, আম্মা আমার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছেন। শুধু চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝড়ছিল।

-এসএম



FacebookTwitter

About Bangla Daily

একটি পরিপূর্ণ বাংলা অনলাইন পত্রিকা। মাতৃভাষার দেশ বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সস্প্রচারিত হচ্ছে।

View all posts by Bangla Daily