সাঁওতালি বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার দাবি

সাঁওতালি বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার দাবি
সাঁওতালি বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার দাবি

আজ ১৭ ফেব্রুয়ারি,২০২৩ জাতীয় প্রেসক্লাবে
উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, সাঁওতাল লেখক ফোরাম-বাংলাদেশ; আদিবাসী সাঁওতাল ফেলোশিপ সমিতি, ঢাকা;
সান্তাল রানাজোট সমিতি, ঢাকা; সাঁওতাল সমন্বয় পরিষদ; দি সান্তালস টাইমস ডট কম; সান্তালি নিউজ২৪.কম এর আয়োজনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত মানববন্ধনে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের লিখিত বিবৃতিতে যা জানানো হয় তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

প্রিয় সাংবাদিক বৃন্দ,
আপনারা জানেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ২০১০ সালের শিক্ষা নীতির আলোকে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী, (নৃ-গোষ্ঠী)’র শিশুরা যাতে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সুযোগ পাই; সে লক্ষ্যে সরকার এগিয়ে আসলেও সাঁওতালদের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ফলে সাঁওতাল শিশুরা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বঞ্চিত। ২০১০ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নির্বাচন করা হয় এবং সরকার ইতোমধ্যে ৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত করেছে কিন্তু সাঁওতালদের মধ্যে লিপি বিতর্কের অজুহাতে এখনো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। একটি শিশুর স্বকীয়তা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা ও মেধার বিকাশ হয় তার মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে। এদিক দিয়ে সাঁওতাল শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় অক্ষরজ্ঞান না থাকায় তাদের সংস্কৃতিও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ। তাই এদেশে প্রত্যেক সাঁওতাল শিশুর নিজস্ব ভাষা ও ভাষার বর্ণমালা শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের সচেতন করা। সেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য ও নারী-পুরুষ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা দূর করা। বিশ^ ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতা বোধ গড়ে তোলা, মানবাধিকার এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষালাভের সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী শিশুসহ সব ক্ষুদ্র জাতি সত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো। সেই লক্ষ্যে সরকার জাতীয় শিক্ষা নীতির (১৮) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করে যে, আদিবাসীরা যাতে নিজেদের মাতৃভাষায় শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্য পুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে এবং পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ণে আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করা হবে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের এ ধরণের পদক্ষেপ খুবই প্রশংসনীয় ও সমাদৃত হয়েছে এবং আমরা এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছি। আমরা বাংলাদেশ সরকারের এ লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে মাতৃভাষা অ-বিকৃত অবস্থায় রেখে কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য অর্জনে সহযোগিতা করার জন্য বরাবর প্রথম থেকেই “সাঁওতাল শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে সাঁওতালি (রোমান) বর্ণমালা” ব্যবহারের জোর দাবি করে আসিতেছি। এই সাঁওতালি (রোমান) বর্ণমালা ছাড়া অন্য কোন বর্ণমালায় এর সুস্পষ্ট উচ্চারণ ও যথার্থ ভাব প্রকাশ করা একেবারেই অসম্ভব। বিভিন্ন সময়ে কতিপয় ব্যক্তি ও সংগঠন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করে তাদের স্বীয় স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে বাংলা কিংবা অলচিকি বর্ণমালায় সাঁওতালি ভাষার বিকৃতি করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে বারবার দায় সারা কথা বলা হচ্ছে যে, সাঁওতালদের নিজেদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন হরফ দিয়ে এই পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হবে? কিন্তু আমরা মনে করি, যখন একটি বিষয় নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয় তখন তৃতীয় পক্ষ যদি না থাকে তাহলে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশে সাঁওতাল ভাষা নিয়ে যে সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কাজ করে এবং যে সমস্ত সাঁওতাল শিক্ষক-শিক্ষিকা স্কুল-কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছেন তাদের অভিমত নিয়েও সরকার একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। আমরা সরকারের নিকট ভাষার শালীনতা ও যথার্থতা এবং মাধূর্যতা রক্ষায় সাঁওতালি (রোমান) হরফে সাঁওতাল শিশুদের জন্য ২০২৩ সালের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণের জোর দাবি জানাচ্ছি এবং সরকারের কাছে ২০২৩ সালের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ করার জোর দাবি করছি।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ২২.১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন, ‘সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ধর্মীয় ও নৃ-জাতিসত্তাগত সংখ্যালঘূদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দৃঢ়ভাবে সমুন্নত থাকবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি, বসতভিটা, বনাঞ্চল, জলাধার ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত ও চা-বাগান শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে।

সরকার আদিবাসীদের সর্ম্পকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি। তারা সংবিধানে উল্লেখিত ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের কোনো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। দেশের ৫০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ লক্ষ শিশু নিজস্ব মাতৃভাষার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আজকে তারা নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না, লিখতে পারে না; ভুলে যেতে বসেছে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকগাথা, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদি। সরকার আমাদের পূর্বসূরীরা যেখানে পূজা-অর্চনা করত তা সে সমস্ত জায়গা বেদখল করা হয়েছে। এ বেদখল চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে আদিবাসীরা পুকুর/জলমহাল পাড়ে বসবাস করে এবং তাদের ঐতিহ্য ও পূজা-পার্বনের জায়গা হচ্ছে এই জলমহালের পাড় কিংবা জঙ্গল। অথচ সরকার ২০০৯ সালের প্রজ্ঞাপনের (ভূমি মন্ত্রণালয়) মাধ্যমে মৎস্যজীবীদেরকে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার জলমহাল ইজারা দেওয়ার কারণে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’র ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশে স¦াধীনতার অর্ধশত বছরে ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে। নতুন নতুন আইন পাশ হয়েছে কিন্তু আদিবাসীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। সরকারের নিকট নি¤েœাক্ত দাবি পুরণে জোর দাবি জানাচ্ছি।
১. ২০২৩ সালের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সাঁওতাল শিশুদের জন্য সাঁওতালি বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত করতে হবে।

২. প্রতিটি জেলায় আদিবাসী কালচারাল একাডেমী প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং আদিবাসীদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি ও কর্মকর্তা নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি পৃথক বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. টিভি,বেতার ও বিভিন্ন মিডিয়ায় আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে এবং আদিবাসীদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫. সরকারি ভাবে আদিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হবে।

৬. আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পুকুর/ জলমহাল সমূহ আদিবাসীদেরকে ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. আদিবাসীদের জমি-জায়গা, কবর-শ্বশান এবং পূজা-পার্বনের স্থান দখল বন্ধে আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠণ করতে হবে।

মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সিনিয়র সহ সভাপতি বদন মুরমু। এসময় বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু, সাঁওতাল লেখক ফোরাম-বাংলাদেশ’র সভাপতি লেখক ও কলামিস্ট মিথুশিলাক মুরমু, মিল্কী সেদেক হাঁসদা, প্রফুল্ল টুডু, শিক্ষার্থী তমা মুরমু প্রমূখ।

-শিশির

FacebookTwitter