কবীর চৌধুরীর শূন্যতা বেশি অনুভব করি-দীপু মনি

কবীর চৌধুরীর শূন্যতা বেশি অনুভব করি-দীপু মনি
কবীর চৌধুরীর শূন্যতা বেশি অনুভব করি-দীপু মনি

শিশির মোজাম্মেলঃ
‘দেশ যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে তখন বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালনের বিরুদ্ধে আমরা কবীর চৌধুরীর শূন্যতা বেশি করে অনুভব করি’- দীপু মনি।

আজ ০৯ ফেব্রুয়ারি (২০২৩) বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তি মিলনায়তনে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা, আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আলোচনা সভায় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন আরণ্যক নাট্যদলের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাট্যকার মামুনুর রশীদ। তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত: নাটক’।

নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির সভাপতিতে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি।

উক্ত আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য প্রদান করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট’-এর সাম্মানিক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি যাত্রাভিনেতা, পালাকার ও নির্দেশক মিলন কান্তি দে, সুরের ধারার সভাপতি সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

অনুষ্ঠানের প্রারাম্ভেই কবীর চৌধুরীর পছন্দের একটি গানের নৃত্যের মাধ্যমে সভা আরম্ভ হয়। নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যশিল্পী তামান্না রহমানের নেতৃত্বে নৃত্যম নৃত্যশীল কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ। এরপর কবিতা পাঠ করেনÑ আবৃত্তিশিল্পী মোঃ শওকত আলী। তিনি অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর রচিত কবিতাবলী থেকে তাঁর বিখ্যাত কিছু কবিতা থেকে বাছাই করা পঙক্তি পাঠ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘১৯৯২-এর জানুয়ারিতে আমরা যখন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করি তখন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ছিলেন ১০১ জন প্রতিষ্ঠাতার তালিকায়, তবে এঁদের সকলেই যে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এমন কথা বলা যাবে না।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম প্রবীণ যাঁদের প্রতিনিয়ত পাশে পেয়েছেন তাঁদের ভেতর অগ্রগণ্য দুটি নাম হচ্ছে কবি সুফিয়া কামাল ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানের জন্য জাতীয় গণতদন্ত কমিশন।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন গণআদালতের বিচারক। জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের জন্য গঠিত এই গণআদালতের ১২ সদস্য বিশিষ্ট বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন ছিলেন জাহানারা ইমাম।’

লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘নির্মূল কমিটি গঠনের পর থেকে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী অপরাপর মৌলবাদী সংগঠনগুলো কবীর চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, আহমদ শরীফ ও শওকত ওসমানকে ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের হত্যার জন্য অনুসারীদের প্ররোচিত করেছে। জামায়াতের ঘাতকদের তালিকায় কবীর চৌধুরীর নাম একাত্তরেও ছিল।

আলবদরের ঘাতকরা দেশের অন্যান্য বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর অনুজ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তারা কবীর চৌধুরীর বাড়িতেও হানা দিয়েছিল। অন্যত্র অবস্থানের কারণে তখন তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। নির্মূল কমিটির আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার পর বহুবার তাঁকে ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।

এসব হুমকি ও মৃত্যুভয় কখনও তাঁকে আন্দোলন থেকে বিযুক্ত করতে পারেনি। নির্মূল কমিটি ছাড়াও তিনি বহু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আন্দোলনের তরুণ নেতা-কর্মী-সংগঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছেন।’

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁকে সম্মানজ্ঞাপন করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি বলেন, ‘বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবীর চৌধুরীর বক্তব্য মুগ্ধ হয়ে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠককে পরিচিত করে দিয়ে গেছেন।’

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এরপর বলেন, ‘আজ দেশ যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে তখন বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালনের বিরুদ্ধে আমরা কবীর চৌধুরীর শূন্যতা বেশি করে অনুভব করি। কবীর চৌধুরী থাকলে নিশ্চয়ই এদের শক্ত হাতে প্রতিহত করতেন।

তাঁর অনুপস্থিতিতে আমাদেরই তাদেরকে শক্ত হাতে রুখতে হবে। এই মৌলবাদীরা ’৫৪ নির্বাচনে বলেছিল ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে’।

বর্তমানেও তারা আওয়ামী লীগকে রুখতে নানা রকম মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে। এ সমস্ত অসাম্প্রদায়িক-মৌলবাদীদের পুনর্বাসন করেছিল জিয়াউর রহমান। তারা আজকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে।’

বর্তমান পাঠ্যসূচি সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘যদি কোন ভুল থেকেই থাকে তাহলে এর গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে তারা তা তুলে ধরুকÑ যেন আমরা তা সংশোধন করতে পারি । কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি মৌলবাদীরা এই বিষয়টিকে ইস্যু করে মিথ্যাচার করছে এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। এমনকি তারা সম্পাদকমণ্ডলীদের হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এদেরকে অবিলম্বে প্রতিহত করতে হবে।’

‘ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অবশ্যই ধর্ম মানুষকে ধৈর্য, সাহস ও শক্তি যোগাতে পারে কিন্তু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করলে তা কল্যাণের চাইতে অকল্যাণই বেশি ডেকে আনে। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয়।’ কবীর চৌধুরীর লেখা থেকে এই উদ্ধৃতি পাঠ করে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতার প্রারম্ভে আরণ্যক নাট্যদলের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নাটকের অনুরাগী মানুষ ছিলেন। তিনি একাধারে যেমন জাতীয় অধ্যাপক, সাহিত্যিক ছিলেন তেমনি ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। তিনি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছিলেন এবং ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন।’

নাট্যকার মামুনুর রশিদ তাঁর স্মারক বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির মানস গঠন ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে নাটকের ভূমিকা তুলে ধরেন।

শততম জন্মবার্ষিকীতে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট’-এর সাম্মানিক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘নির্বিবাদী নয়, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি ভাল মানুষ।

এই কথাটি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তিনি আমৃত্যু অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিবাদ করে গেছেন। তার জীবন ও কর্ম থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’

‘আজকে আমরা যখন অসাম্প্রদায়িক অপশক্তি তথা স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন দেখছি তখন ভীষণভাবে কবীর চৌধুরীর অভাব বোধ করছি’ মন্তব্য করে নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সকলের জন্য একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।

তার মত কর্মনিষ্ঠ নেতৃত্ববান মানুষ খুব কমই এ পৃথিবীতে এসেছে। তিনি অসাধারণ হয়েও খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কবীর চৌধুরী কেবল পিতা মাতার ১৪ সন্তানের মধ্যেই অগ্রজ ছিলেন না বরং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের সকলের অগ্রজ ছিলেন।

তার অবর্তমানে আমরা আমাদের অগ্রজ কবীর চৌধুরীর প্রাণের সংগঠন এবং একাত্তরের ঘাতক দালালদের প্রতিরোধকারী সংগঠন ‘নির্মূল কমিটি’র সমস্ত কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়েছি ও নিয়ে যাব।’ তিনি কবীর চৌধুরীর জীবনী পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন।’

শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘বর্তমানে মৌলবাদীদের আস্ফালন কবীর চৌধুরীর শূন্যতাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়। তিনি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যেকোনও আন্দোলনের পুরোভাগে থাকতেন।

জিয়াউর রহমান সাম্প্রদায়িক অপশক্তির যে বীজ বাংলাদেশে বপন করে গেছেন তার ফল বাংলাদেশ এখনও ভোগ করছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী রাজাকার, আল-বদরদের বংশধরদেরকে সরকার কেন গ্রেফতার করছে না তা আমার বোধগম্য নয়।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন ‘আইসিটি আইন কী কেবলমাত্র সংখ্যালঘু ও হিন্দুদের ওপর প্রয়োগ করার জন্যই?’ ।’

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ওয়াজিদের সম্পর্কে আরও বলেন, ‘ওয়াজকারীরা ওয়াজের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছে এবং হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা কেবল ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ইনকামই করছে না বরং এসব ওয়াজের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্তও করছে। এদেরকে এখনই শক্ত হাতে প্রতিহত করতে হবে।’

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে সশ্রদ্ধ সম্মান নিবেদনের পর বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি যাত্রাভিনেতা, পালাকার ও নির্দেশক মিলন কান্তি দে বলেন, ‘মৌলবাদ-ধর্মান্ধতা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগের বিষয়। এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের জাগরণ প্রয়োজন।

এই জাগরণ মনোজগতের জাগরণ। এ লক্ষ্যে কাজ করার জন্য নির্মূল কমিটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করেছে যার নাম ‘জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড’। এর লক্ষ্য মানুষের মনোজগতে ধর্মান্ধতার কালো ছায়া দূর করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়া।’

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে সুরের ধারার সভাপতি সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, ‘কবীর চৌধুরীর অসাম্প্রদায়িক চেতনা তার সমস্ত লেখা ও কর্মের মাঝে ফুটে উঠেছে। সেখান থেকে নতুন প্রজন্মের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে।’

কবীর চৌধুরীর আত্মজীবনী জাতীয় কারিকুলামের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কবীর চৌধুরীর প্রিয় গান ‘নাই বা হলো পারে যাওয়া’ পরিবেশন করে তার বক্তব্য শেষ করেন।

আলোচনা সভার পর অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সাইফউদ্দিন রুবেল পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র ‘নাই বা হলো পারে যাওয়া’র উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

-শিশির

FacebookTwitter