‘শ্বেতপত্রের সুপারিশ আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো’

বাংলাদেশ এখন ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক দেশঃ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশ এখন ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক দেশঃ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

অনলাইন রিপোর্টঃ

আজই প্রকাশ হওয়া শ্বেতপত্র হাতে পেয়েছি। ভালভাবে পর্যবেক্ষণপূর্বক শ্বেতপত্রের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো।

১২ মার্চ (২০২২) বিকাল ৩টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক ‘শ্বেতপত্র: বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আসাদুজ্জামান খান এমপি এ কথা বলেছেন।

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গিবাদ কোনো ধর্মের আদর্শ হতে পারে না। জঙ্গিরা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য তারা বেছে বেছে সংখ্যালঘু থেকে শুরু করে বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করেছে।

আমরা অনেক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছি। আমাদের কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। যে বা যারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করুক না কেন আমরা তাদের কাউকেই ছাড় দিব না।’

মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ডাকে সাড়া দিয়ে সারা দেশের মানুষ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে মা তার জঙ্গি সন্তানকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আজ জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের কর্মকতৎপরতার প্রশংসা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনাব শাহরিয়ার কবিরের অসাম্য কাজ শ্বেতপত্র প্রকাশনার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, নির্মূল কমিটি যদি শ্বেতপত্র না করত তাহলে আমরা অন্ধকারেই থেকে যেতাম।

শাহরিয়ার কবিরের উদ্যোগের জন্য আমরা দেশ-বিদেশ থেকে তার প্রশংসার কথা শুনতে পাই। এজন্য আমি তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চাই।’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন-এর সদস্য রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন এমপি, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ-এর সভাপতিম-লীর সদস্য সমাজকর্মী কাজল দেবনাথ, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি ও গণকমিশনের সদস্য শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, রিজিওনাল এন্টি টেররিস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর নির্বাহী পরিচালক ও মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন-এর সদস্য মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) এবং বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ-এর নির্বাহী পরিচালক সমাজকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর।

এছাড়াও নির্মূল কমিটির নেতাকর্মী, গণকমিশন সদস্যবৃন্দ এবং গণকমিশনের সচিবালয়ের অন্যান্য সদস্য উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

সভাপতির বক্তব্যে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে জঙ্গিদমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য প্রদর্শন করলেও জঙ্গি মৌলবাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করার কোনও সরকারি উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

যেহেতু এই সন্ত্রাস হচ্ছে ধর্মের নামে এবং নির্দিষ্ট একটি আদর্শকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সেহেতেু জঙ্গি মৌলবাদকে আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার আদর্শের আলোকে আমাদের শিক্ষানীতি ও সংস্কৃতিনীতি প্রণয়ন করতে হবে।

’৭২- এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। ধর্মের নামে রাজনীতি থাকলে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্নজীবনধারার অনুসারী মানুষরা বারবার আক্রান্ত হবে, সমাজে উগ্রতা ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাবে, আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যহত হবে এবং জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির ভেতর পড়বে।’

শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার কারণে বহু ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ভুক্তভোগীকে মামলায় আসামী করা হচ্ছে। আমাদের শ্বেতপত্রে ঝুমন দাস, রসরাজ বর্মন সহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার এ ধরণের ভুক্তভোগীদের প্রতি প্রশাসনের অমানবিক আচরণের বিবরণ রয়েছে, যারা বছরের পর বছর মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গিয়েছে। আমরা অবিলম্বে এসব মামলা প্রত্যাহার এবং সাম্প্রদায়িক হামলার ভুক্তভোগীদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলার জন্য ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠন এবং ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের অঙ্গীকার ছিল। দূর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা আবারও ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ কার্যকর এবং বিচারিক ক্ষমতা সহ ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠনের দাবি জানাচ্ছি।

আমাদের শ্বেতপত্রে সরকার ও নাগরিক সমাজের জন্য যে সব সুপারিশ করা হয়েছে, এগুলো বাস্তবায়িত হলে নিশ্চিতভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারব।’

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন-এর সদস্য রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, ‘আমরা শ্বেতপত্রে যে সুপারিশগুলো করেছি তা নতুন কিছু নয়।

ইতোপূর্বের শ্বেতপত্রগুলোতেও নির্মূল কমিটি তদন্ত করে প্রায় একই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে বলেছিল। জামায়াত-হেফাজত মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারাদেশে যেভাবে তা-ব চালিয়েছে তাতে শত বছরের পুরানো স্থাপনাসহ সাধারণ মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। হেফাজত নেতা মামুনুল হক ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করে। এই স্বাধীনতা দেশে তার এতবড় কথা বলার দুঃসাহস কোথা থেকে এলো? হেফাজত এখন জামায়াতের ছায়া হয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে ওয়াজিরা যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে সাফাই গায়ছে যা সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী। আমরা অবিলম্বে এই চক্রান্তকারীদের নির্মূল করার আহ্বান জানাই।’

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ-এর সভাপতিম-লীর সদস্য সমাজকর্মী কাজল দেবনাথ বলেন, ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২০০০ দিনের একটি শ্বেতপত্র জাতির কাছে প্রকাশ করেছে। এর আগে তারা আরো ৭টি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী সংখ্যালঘু নয়।

সংখ্যালঘু তারা যারা সংখ্যায় মাত্র পাঁচ থেকে দশ লক্ষ এবং বাংলাদেশের সর্বনাশ করতে চায়। ২০০১ সালে শাহাবুদ্দিন কমিশন গঠন করা হলো। অনেকগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু একজনেরও বিচার হয়নি। এই শ্বেতপত্র লাইব্রেরিতে, জাদুঘরে রাখার জন্য নয় বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি শ্বেতপত্রে দেয়া সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণ করুন, আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করুন। এই শ্বেতপত্র যদি সরকার আমলে নেয় তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ মাথা উচুঁ করে দাড়াবে।’

নির্মূল কমিটির সহসভাপতি ও গণকমিশনের সদস্য শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘মৌলবাদী গোষ্ঠী কি সমস্যা এবং সর্বনাশ করেছে তা লিপিবদ্ধ করা আছে। ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে সাম্প্রদায়িকতা শেখানো হচ্ছে। ভিন্নমতের ভিন্ন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের সমাজের বর্তমান মৌলিক চিত্র। এসব কারা করছে? কারা শিশুদের মগজে এসব ঢুকিয়ে দিচ্ছে। শ্বেতপত্রে এসব বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।’

রিজিওনাল এন্টি টেররিস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর নির্বাহী পরিচালক ও মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন-এর সদস্য মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। দুঃখের বিষয় আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আজ বাংলাদেশে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে বঙ্গবন্ধু প্রণীত ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে এবং এখনো বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা রয়েছে তাদের নির্মূলনে গণকমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।’

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ-এর নির্বাহী পরিচালক সমাজকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর বলেন, ‘ধর্মের নামে যে ঘৃণিত কাজগুলো হয় তা আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে। সংখ্যালঘুদের উপর যে সংঘাত সংখ্যালঘু নির্যাতন বলতে আমরা সেটিকে বুঝি। এর আগে বিভিন্ন নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জামায়াতে ইসলাম ধর্মের নামে সংখ্যালঘুদের উপর অব্যাহত নির্যাতন করেছে। শ্বেতপত্রে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নামে সংখ্যালঘুদের উপর এবং ভিন্নমতের মানুষের উপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন তা তুলে ধরা হয়েছে। শ্বেতপত্রে অনেকগুলো বিষয়ের উপর সুপারিশ করা হয়েছে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।’

গণকমিশন- এর সভাপতি বিচারপতি শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দিনাজপুরে একটি পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কারণে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে না পারলেও তিনি এক ভিডিও বার্তায় তার বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যে বিচারপতি শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত এই কারণে যে, দীর্ঘ প্রতিক্ষিত এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনের বিরোধিতা করে এবং তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুুদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, মন্দির ও পূজাম-পে হামলা করে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গঠিত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন ঘটনাগুলোর তদন্ত শুরু করে। দীর্ঘ নয় মাস তদন্ত করে এর ফলাফল ও কমিশনের সুপারিশ সহ ‘বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শ্বেতপত্রের আকারে প্রকাশ করছে।’

পাঠানো ভিডিওতে গণকমিশন- এর সভাপতির সঙ্গে ছিলেন সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও কমিশনের সদস্য মানবাধিকার নেতা নির্মল রোজারিও।

-শিশির

FacebookTwitter