আইন আদালতঃ
চিত্রনায়িকা পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলার তদন্ত শেষে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ।
চার্জশিটে দোষী উল্লেখ করা বাকি ২ জন হলেন তুহিন সিদ্দিকি অমি ও শাহ শহিদুল আলম।
মামলার প্রতিবেদনে পরীমণিকে সরাসরি ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করলেও যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যার হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
সেই রাতে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী ঘটেছিল তার বিস্তারিত বর্ণনাও উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে।
গত সোমবার (৬ আগস্ট) আদালতে জমা দেওয়া ওই চার্জশিটে সাক্ষী করা হয়েছে ১২ জনকে। যার মধ্যে পরীমণির খালাতো বোন ফাতেমাতুজ জান্নাত বন্নি, সহযোগী জুনায়েদ বাগদাদী জিমি, আশরাফুল ইসলামসহ ঢাকা বোট ক্লাবের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
চলতি বছরের ১৪ জুন সাভার থানায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ, বন্ধু তুহিন সিদ্দিকি অমিসহ অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার একটি মামলা দায়ের করেন পরীমণি।
মামলার এজাহারে পরীমণি অভিযোগ করেন, অমির কথামতো ৮ জুন বোটক্লাবে যান তারা। এ সময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে টয়লেট ব্যবহারের পর ফেরার সময় নাসির উদ্দিন মাহমুদ জোর করে মদ খাওয়ান। মদ খেতে না চাইলে মুখে মদের বোতল প্রবেশ করিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে নাসির উদ্দিন মাহমুদ তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থান স্পর্শ করেন ও তাকে জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করেন।
ঘটনা তদন্তে পুলিশ যা পেয়েছে
পরীমণির দায়ের করা আলোচিত এই হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত করেন সাভার থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কামাল হোসেন। তদন্ত শেষে আদালতে দেওয়া চার্জশিটে তিনি বলেছেন, ঢাকা বোটক্লাবের এক্সিকিউটিভ মেম্বার আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী আগে থেকেই পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। তুহিন সিদ্দিকী মামলার বাদী পরীমণিরও পূর্বপরিচিত। গত ৮ জুন সন্ধ্যায় পরীমণির কসটিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বাগদাদী জিমি এই চিত্রনায়িকার বনানীর বাসায় যান। এরপর রাত সাড়ে ৮টায় সেখানে আসেন ফাতেমাতুজ জান্নাত বন্নি। রাত ১০টার দিকে পরীমণির বাসায় যান অমি। সেখানে রাতের খাবার শেষে তারা বন্নির উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দেন।
টিভি দেখা রেখে মদ পান
চার্জশিটে বলা হয়েছে, “তুহিন সিদ্দিকী অমি ‘কৌশলে’ পরীমণি ও তার সঙ্গীদের নিয়ে রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা বোটক্লাবের বারে প্রবেশ করেন। বারে যাওয়ার বিষয়টি তুহিন সিদ্দিকী আগেই ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদকে জানিয়ে রাখেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদ তখন তাদের জন্য একটি টেবিল বরাদ্দ রাখতে বোটক্লাবের ম্যানেজার আবদুর রহিমকে বলেন। এরপর পরীমণি ও অন্যরা বোটক্লাবে প্রবেশ করেন। আগে থেকেই ক্লাবে থাকা ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও আরেক আসামি শাহ শহিদুল আলমের সঙ্গে পরীমণি ও তার সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দেন অমি। সেখানে জিমির হাফপ্যান্ট পরে ক্লাবে প্রবেশ করা নিয়ে শহিদুল আলমের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। তারপর তারা সবাই মিলে ২ বোতল ব্লু লেভেল মদ পান করেন। এ সময় আরেকটি টেবিলে বসা নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলমসহ অন্যরাও মদপান করেন। এরপর রাত সোয়া ১টার দিকে নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলম বাসার উদ্দেশে রওনা দিলে পরীমণি ও অন্যরা তাদের ফের ডেকে আনেন এবং টিভিতে গান ছেড়ে সবাই মিলে মদপান করেন।”
পরীমণি মদের বোতল পার্সেল নিতে চেয়েছিলেন
চার্জশিটে আরও বলা হয়েছে, ‘খাওয়া শেষে পরীমণি ৬টি ব্লু লেভেল মদের বোতল পার্সেল নিতে চান। তবে বোটক্লাবে ১ লিটারের ৬টি বোতল না থাকায় ওয়েটার পরীমণিকে জানান, একটি ৩ লিটারের বোতল আছে। তখন পরীমণি সে বোতলটি ওয়েটারকে দিয়ে আনান। পরীমণির সঙ্গে থাকা ফাতেমাতুজ জান্নাত বন্নিও দুটি রেড ওয়াইন পার্সেল নেন। তাদের আগে পান করা মদসহ বন্নির নেওয়া দুটি মদের বোতলের দাম আসে ৮৮ হাজার ৬১০ টাকা, যার পুরোটাই পরিশোধ করেন তুহিন সিদ্দিকী অমি।’
পরীমণিকে ‘প্রস্টিটিউট’ বলে গালি, নেপথ্যে ৩ লিটারের ব্লু-লেভেল মদ
চার্জশিটে পুলিশ বলছে, ‘পরীমণির নেওয়া ৩ লিটারের ব্লু-লেভেল মদের দাম ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা হওয়ায়, সেই বিল যেন না দিতে হয় সেজন্য কৌশল অবলম্বন করেন তিনি। নাসির উদ্দিন মাহমুদকে দিয়ে অমি কৌশলে পরীমণিকে বলেন, এই বোতল ক্লাবের স্যাম্পল, এটা পার্সেল দেওয়া যাবে না। এ নিয়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। একপর্যায়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদ অমিকে বলেন, এরকম প্রস্টিটিউট মেয়েকে কেন ক্লাবে এনেছ?’
থাপ্পড়, হুমকি ও বোতল-গ্লাস-অ্যাশট্রে ভাঙচুর
চার্জশিটে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, ‘এ সময় জিমি নাসির উদ্দিন মাহমুদকে বাধা দেওয়াসহ ঘটনার ভিডিও করতে চেষ্টা করলে শাহ শহিদুল আলম জিমিকে থাপ্পড় মারেন ও হুমকি দেওয়া শুরু করেন। ফলে পরীমণি ক্ষিপ্ত হয়ে পানির বোতল, গ্লাস ও অ্যাশট্রে ভাঙেন এবং নাসির উদ্দিন মাহমুদকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন। তবে নাসির উদ্দিন মাহমুদ সরে যাওয়ায় সেগুলো তার গায়ে লাগেনি।’
পরীমণিকে থাপ্পর মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দেয়া হয়
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এ সময় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলম পরীমণির সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন। তারপর এই দুই আসামি পরীমণিকে গালিগালাজ করতে করতে তাকে থাপ্পড় মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দেন এবং হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। রাত পৌনে ২টার দিকে নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলম বোটক্লাব থেকে চলে যান।’
লাইট, এসি ও ফ্যান বন্ধ করে দেয়ায় পরীমণির শ্বাসকষ্ট
চার্জশিটে বলা হয়েছে, ‘ক্লাবের কর্মচারীরা পরীমণিকে ক্লাব থেকে বের হওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি সেখানে বসে থাকেন। ফলে তারা কিছু লাইট, এসি ও ফ্যান বন্ধ করে দেন। এ কারণে পরীমণির শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ফের এসি, ফ্যান ও লাইট চালু করা হয়। রাত ২টার দিকে বোট ক্লাবের এক প্রহরীর সহায়তায় জিমি পরীমণিকে গাড়িতে তোলেন।’
ঘটনার সূত্রপাত ৩ লিটারের ব্লু লেভেল মদ
চার্জশিটে বলা হয়েছে, “মামলাটি তদন্তকালে প্রতীয়মান হয়েছে, ৩ লিটারের ব্লু লেভেলের দাম তুহিন সিদ্দিকী না দিয়ে ‘কৌশলে’ নাসির উদ্দিনকে দিয়ে ক্লাবের স্যাম্পল বলানোয়, সেগুলো নিতে আরও বেশি আগ্রহী হন পরীমণি। এ নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে আসামিরা পরীমণিকে মারধর করে শরীরে জখম করেন এবং হুমকি-ধমকি দেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলম পরীমণির সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করা ও তার শরীরে স্পর্শ করে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করার বিষয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারাসহ পেনাল কোডের ৩২৩/৫০৬ ধারার অপরাধ। আর তাদের সহযোগিতা করায় তুহিন সিদ্দিকী অমি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩০ ধারায় অপরাধ করেছেন।”
-কেএম