ফরিদা ইয়াসমীন জেসি, লন্ডন থেকেঃ
ছোটো বেলায় বড় কাক্কার রেডিওতে একটা গান শুনতাম, যখন আমাদের নিজেদের কোনো রেডিও ছিলোনা। গানটি ছিলো এই রকম-
দেশকে ভালবেসে বসে থাকলে,
চলবে নারে চলবে না।।
মানুষকে ভালবেসে বসে থাকলে,
চলবে নারে চলবে না।।
আমি দেশকে ভালবাসি, ভালবাসি দেশের মানুষকে। আমি এখন বৈদেশে থাকি, আমার দেশ, আমার মাটি থেকে অনেক দুরে।
আমি এখানে দেশের সকাল দেখিনা, বৈকাল দেখিনা ,জোছোনা দেখিনা, রোদ্দুর দেখিনা। আমার সকাল হয় এলার্মের ক্রিন ক্রিন শুনে। নাস্তা হয় বাটার আর ব্রেডে কিন্তু বোধের ভেতর থাকে আমার মায়ের হাতের পুটি মাছ আর মুলার তরকারীর সাথে কড়কড়া ঠান্ডা ভাতের নাস্তা। অথবা গরম গরম ভাতের সাথে সিম আলুর ভর্তা। আমার অন্তর জুড়ে থাকে সকালের মিঠা রোদে শিতল পাটিতে বসে ভাপা পিঠার সাধ। আমি লুকিয়ে রাখি সে সাধ গোপন করে বুকের ভেতর। হাড়িয়ে যেতে দেইনা।
বিলেতের লেদারের আয়েশি সোফায় বসেও আমার ভাল্লাগেনা, আমি আব্বার বানানো কাঠের পিড়িতে বসার সুখ খুজি, মা বসতো, আমি বসতাম, দাদিমা বসতেন, বড় চাচি আম্মা বসতেন, হাড়িকেন জালিয়ে শিতের সন্ধায় কাঠের পিড়িতে চুলার পাশে বসে গল্প করার মধুর সৃতি জিইয়ে রাখি সপ্নের ভেতর আজো। এখানকার বরফে ঢাকা শক্ত রুই কাতলা ফেলে আমার খেতে মন চলে যায় আব্বার আনা পুটি মাছের চচ্চুরি,শৈল মাছের ভর্তায়। এসব আমার কাছে এখন ইতিহাস। নাই বা বলি জীবনের সোনালী সেই দিনের কথা, কিন্তু সেই দিনের ভাবনা গুলি নিয়ে আমি ফিরে তাকিয়ে থাকি দেশের পানে, মানুষ এর পানে। কাজ করতে নেমে আসি অসহায় মানুষ এর জন্যে । ছুটে যাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
আমার সাথে থাকে দয়াবান মায়াবতী মানুষেরা। তাদের অসাধারণ সহায়তার হাত। অনেকে প্রশ্ন করেন, দেশে যাও না অথচ কাজ করো কিভাবে? কি করে করো এপার থেকে অপারের কাজ?
তাহলে বলি শোনো এবারের মেডিকেল ক্যাম্প আর আর্ন এন্ড লিভের উদ্ভোদনির গল্পটা। আমার ছেলেবেলার বন্ধু সাবিনা, একই সাথে বিদ্যালয়ে পড়তাম। রোজার ঈদে খবর পেলাম ঈদের দিন রাতে তার ২২ বছরের ছেলেটিকে কারা যেনো ছুড়িতে আঘাত করতে করতে স্পটে মেরে ফেলেছে।
শুনে আমি বিস্মিত, এরপর একজন বন্ধুর পাশে দাড়ালাম আমি। একজন সন্তানহাড়া পাগলি মায়ের পাশে দাড়ালাম, সান্তনা দিতে, তার কষ্ট লাগব করতে। কিই বা করতে পারি কথার শান্তনা দেয়া ছাড়া।
কথা বলি, গল্প বলি, বেচে থাকার উৎস বলি তাকে কিন্তু কান্না থামেনা, মায়ের আহাজারি থামেনা। বলি এবার সপ্নের কথা, নতুন করে বলি সপ্ন দেখার কথা। বলি এক সন্তান চলে গেলেও হাজারো সন্তানেরা আছে পথে,কুটিরে, বন্দরে। শুধু দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। আমাকে দেখো আছি এই শিশুদের নিয়ে, অসহায় মায়েদের নিয়ে।
ভেবে দেখো, তুমি পেছনে যেতে পারবে না নতুন শুরুর জন্য,যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখান থেকে শুরু করে কাজ করে যেতে পারো একটা সুন্দর শেষের জন্য। আমি তোমাকে প্লাটফর্ম বানিয়ে দিচ্ছি।
এবার থেমে যায় কান্না তার। যখন বলি হাজারো সন্তানেরা আছে, কাদছে। তুমি হাত বাড়াও। সময়কে মেনে নাও। এরপর হয় পরিকল্পনা শুরু, আছিরগঞ্জে হবে আর্ন এন্ড লিভ, বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য।হবে ফ্রি ম্যাডিকেল ক্যাম্প প্রতিবন্ধী বাচ্চা ও তাদের পরিবারের জন্য।
শুরু হয় মিটিং , আলোচনা , লোকজনের আসা যাওয়া আমার বন্ধুর বাড়িতে। ভুলে যায় বন্ধুটি আমার সন্তানের জন্য কান্না। পথের সন্তানের কথা ভেবে শুরু হয় তার সপ্ন দেখা। কথা বলি আমরা ঘন্টা থেকে ঘন্টা।
– চা নাস্তার ব্যাবস্থা কিছুই যেনো হয়না তোর মনটা থাকেনা ভালো।
– একি কথা বলিস, মেহমান আসবে ঘরে আর না খেয়ে হবে বিদেয়? না না। নিজের হাতে করছি রান্না করছি আয়োজন। খেয়ে যেতেই হবে।
– অনুষ্ঠান এর জন্য আজ যাবে বাসায় সাংবাদিক, আয়োজক, সাথে থাকবে আরো দু জন গুনি লোক।
– আসবেইতো। এত বড় অনুষ্ঠান করছি। আলোচনা করতে হবে। প্ল্যান বানাতে হবে।আমি করছি ডাক্তার এর আয়োজন। চিন্তার কিছু নেই।
– এলাকায় যেতে হবে, যারা কাজ করতে ইচ্ছুক তাদের বাছায় করতে হবে।-
– বাছায় করার কাজ শেষ আমার, আফিয়া আপা ছিলো সাথে।
এভাবেই শুরু তারপর একে একে জয়েন হয় এলাকার মকবুল, শামসুল আলম রুকন, নুরুল ইসলাম লেচু, দেবারাই যুব সংঘ,সহ অন্যান্য। উদ্যম আর উচ্ছাস তাদের চোখে মুখে। এ তো মানবতার কাজ। আছি আমরা মানুষ এর পাশে। সিলেট শহর আর আছিরগঞ্জ গ্রাম এক ঘন্টার পথ। আসা যাওয়া চলছে অবিরত, মিটিং স্পট সাবিনার বাসা, অনুষ্ঠান আয়োজন আছিরগঞ্জ। স্টেজ হলো, গেট হলো, ডাক্তারের আসন হলো, সাংবাদিকদের আসন হলো। ফিজিও থেরাপির ভ্যান হলো।
কাজ এর ইন্সট্রাকশন চলতে থাকলো ফোনে লন্ডন থেকে। মানুষ কে ভালবাসার, মানুষ এর জন্য কাজ করার প্রফুল্লতা টা যে কি ওরা অনুভব করলো অন্তর দিয়ে।
কথা হলো ফোনে চিত্র নায়ক ফারুক ভাই এর সাথে। উনি আমাদের আর্ন এন্ড লিভের উপদেষ্টা। থাকছেন উনি, থাকছেন সহিদুল আলম সাচ্চু, অধ্যক্ষ আতাউর রহমান পীর, হাজি মুমিন আলি। থাকছেন সামাদ ভাই এর রিপোর্টার বাংলা টিভি নিয়ে, থাকছেন লেখক সাংবাদিক অপুর্ব শর্মা, থাকছেন এডভোকেট রিপোর্টার আব্দুল মুকিত অপি, সাংবাদিক কাইয়ুম উল্লাস,সাংবাদিক মইনুল হাসান টিটু, ক্যামেরা পারসন আলমগীর হোসেন। থাকছেন জীবন খান মিডিয়া নিয়ে।
মেডিকেল ক্যাম্পে প্রায় দুই শতাধিক রোগিকে চিকিৎসা, মেডিসিন ও পিজিও থ্যারাপি দেয়া হয়।
অনুষ্ঠান চলার সকালে লিখে পাঠালাম আব্দুল মুকিত অপিকে, বিলেতের কনকনে শিতের সকালেও টেনশনে কপালে ঘামের ফোটা। কি করি, খবর কি? রাত জেগে থাকলাম, দেশের সকালের জন্য। ছবি আসতে থাকলো অপি আর অপুর্ব দা র কাছ থেকে। ক্লিক ক্লিক। এরপর এর যা হলো ছবি কথা বলবে——
বিঃদ্রঃ বরাবরের মত এবারেও যারা কাজগুলি নিষ্ঠা আর ভালবাসা দিয়ে করে গেলেন। ভলান্টারিলি, দু একজন ছাড়া কায়কেই আমি দেখিনি। সবাইকে প্রানঢালা শুভেচ্ছা, আপনাদের সোয়াব রইলো আল্লাহর দরবারে। যে বন্ধুরা এই কাজে ফাইনানসিয়ালি সহায়তা দিচ্ছ মোরশেদা সহ আল্লাহ সবার দান কবুল করুক।