মাহবুবুর রহমান রাজুঃ
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেয়া লক্ষ বীর শহীদের বিদেহী আত্মার প্রতি মাগফিরাত ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে বাস্তব দর্শন থেকে ১৯৭১ ‘ র দৃশ্যপটের সাদাকালো কয়েকটি ছবির আত্বকাহিনীর আংশিক ঘটনাবলির অবতারনা করছি। ছবিগুলো শুধু ছবি নয় স্বাধীন বাংলার ইতিহাস! তৎকালীন অনেক ছবিই আমার কাছে ছিল সংরক্ষণ করা হয়নি।
তখন ভেবেছিলাম এসব দিয়ে আর কি হবে? দেশ তো স্বাধীন হয়েছে,আর কি? এলবামে তখনকার সাদাকালো ছবি গুলো ঘেমে মরিচা পড়ে নষ্ট হচ্ছিলো তাই ফেলে দিয়েছি।সে গুলো আজ অনেক তথ্য উপাত্য হিসাবে সালসা বা টনিকের মতো কাজে লাগতো, তাই কবি গুরুর উক্তিটি ই যথার্থ,যেখানে দেখিবে ছাই!…….
এখন যারা লাগাম ছাড়া বড় বড় কথা বলে তাদের জন্য সেগুলো স্বাধীনতার দলিল হিসেবে অকাট্য প্রমাণ হতে পারতো, অবশ্য তার প্রয়োজন নেই, দেরিতে হলেও দেশবাসী ও নতুন প্রজন্ম ইতিমধ্যে অনেক কিছুই অবগত হয়েছে , মনে প্রানে যারা স্বাধীনতা চায়নি এসব কে তারা এখনো গাত্রদাহের কারন মনে করে, তাই ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু জানার চেষ্টা করছি।
দেশের জন্য যারা জীবনকে তুচছ ভেবে,ঝাপিয়ে পড়েছিল রনাংগনে,তারা প্রতিমূহুর্তে অনুভব করতো যে ইহধাম ত্যাগ করার জন্য শত্রুর একটি বুলেটই যথেষ্ট। যারা ভাবেনি কখনো স্বার্থের কথা, নিজেদের আখের গোছানোর কথা, ভাবেনি অর্থ বিত্ত বৈভবের কথা! লোভ হয়নি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার, একটাই অভিষ্ঠ লক্ষ শত্রু মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ।দেশের সাথে প্রেম করলে,ভালবাসলে বুঝি এমনটাই হয়,এমনি হওয়া উচিৎ।
ছবিটিতে উপরে হ্যাচাক লাইটের আলোতে যোদ্ধাদের রাজনৈতিক দিক্ষা দিচ্ছেন দাদা ভাই খ্যাত রাজনীতির রহস্য পুরুষ সিরাজুল আলম খান ,বামে শেখ কামাল ডানে হাসানুল হক ইনু সহ আরো অনেকে।
নিচের ছবিতে বামে নলডাংগার মান্নান ভাই,মাঝখানে মিজান ভাই,ডানপাশে হ্যাট পরিহিত এম এ আউয়াল মিয়া ,BLF গেরিলা,(100 soldiers=1 gorilla)এরিয়া কমান্ডার মুজিব বাহিনী। আমাদের পরিবারের ভাই-বোন দের মধ্যে সবার বড়। তৎকালিন গাইবান্ধা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক, সংগত কারনেই তার পক্ষে সে সময় ঘরে নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করা সম্ভব ছিল না,বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে রাতের অন্ধকারে পর পর দু বার যুদ্ধ যাত্রা ব্যার্থ হয়,এক পারিবারিক অসম্মতি দুই ছাত্র হওয়ায় পরিস্থিতির কারণে বাপের হোটেল সাময়িক বন্ধ হওয়ায়,পথ খরচের সুরাহা করা কঠিন হয়ে দেখা দেয় । অবশেষে তার ও সমাধান বের হলো। সেটি একটি মজার ঘটনা , চাচাত ভাই সিরাজুল ইসলামকে সাথে নিয়ে আরেক চাচাতো ভাই মফিজুল হক (তত্কালীন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার পরবর্তিতে ফুড ইনস্পেক্টর) এর বাশের খুঁটিতে রক্ষিত সম্পদ আমরা বলি বাঁশের পই (সেই সময়ে বাঁশের দুই গিট্টির মাঝের অংশকে আড়াল করে কৌশলে পয়সার আকারে কেটে ব্যাংক এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো) তা নিঃশব্দে কেটে সেখান থেকে মাত্র ২৫ টাকা হাত খরচ পেয়ে আবার রাতের অন্ধকারে পাড়ি জমান অপেক্ষা মান নৌকায় । ওপারে গিয়ে ভারতের দেরাদুন ক্যাম্পে উঠেন,সেখানে গিয়ে দাদা ভাই খ্যাত রাজনীতির রহস্য পূরুষ সিরাজুল আলম খান, স্বাধীনতার অন্যতম রুপকারকে পেয়ে যান,বুকে জড়িয়ে নেন দাদা ভাই, instractor হিসেবে পেয়ে যান হাসানুল হক ইনুভাইকে,সেখানে আগে থেকেই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন বংগবন্ধু পুত্র শেখ কামাল ভাই। এম এ আউয়াল ভাইয়ের সাথে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন বাদিয়াখালির কাফি ভাই অবসর প্রাপ্ত কাষ্টম কমিশনার, বোনার পাড়ার রুসতম ভাই, গাইবান্ধার আরো কয়েকজন।
ভারতের সেই ঐতিহাসিক দেরাদুন ক্যাম্ফ থেকে হায়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ছড়িয়ে পড়েন সারা পূর্ব পাকিস্তানে । এই বাহিনীটি গঠনের একটা উদ্দেশ্যে ছিল ,যদি ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলতে থাকে তবে সাধারণ স্বল্প প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও স্বল্প শিক্ষিত যোদ্ধারা বেশি দিন যুদ্ধক্ষেত্রে কুলে উঠতে পারবে না, এরকম অনেক গুলো কারণের মধ্যে এটি অন্যতম কারন ,তাই উচ্চ শিক্ষিত স্মার্ট ও চৌকশদের নিয়ে দীর্ঘস্হায়ী যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভারতের দেরাদুন ক্যাম্ফে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন মুজিব বাহিনী,যার পরিচালনায় তৎকালীন তুখোর কয়েকজন রাজনীতিবিদ, তাদের মধ্যে ছিলেন, তোফায়েল ভাই,আব্দুর রাজ্জাক,শেখ মনি,ও প্রচার বিমুখ আমাদের রাজনৈতির রহস্য পুরুষ দাদাভাই খ্যাত সিরাজুল আলম খান। ক্যাম্প থেকে ফিরে আসেন আউয়াল ভাইয়ের সাথে যাওয়া চাচাতো ভাই সিরাজুল ইসলাম শারিরীক যোগ্যতার অভাবে,কাফী ভাইকেও আনফিট মনে করে বাহিনী তে নিতে চায়নি ,পরে আউয়াল ভাইয়ের অনুরোধে তাকে সাথে রেখে ছিলেন।
বামনডাংগার অনিল দা অনেক চেষ্ঠা করে ইচ্ছে থাকা সত্বেও ব্যার্থ হয়েছেন। আউয়াল ভাই তার মৃত্যুর আগে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার বাসায় কিছু দিন অবস্থান করেন সেই সময়ে কোন এক অবসরে আমাকে তার যুদ্ধ যাত্রা ও যুদ্ধজয়ের খন্ডিত কিছু অংশ বলেছিলেন পাশাপাশি এও বলেছিলেন যদি পারিস কোনদিন তোর সময় হয় তবে স়ংগ্রহে রেখে দিস। এখন অনেক কিছুই আমার মনে নেই, তাছাড়া লিখতেও জানিনা। সাধু-চলিতের সিরিয়াল মেইনটেইন করা মন প্রলুব্ধ করা শব্দ গাথুনী না জানার কারণে লিখতে সাহস পাইনা।
যা বলতে চাইছি,সে সময়ের কিছু দেল মে পাকিস্তান প্রেমী নিজেদের সম্পদ সুরক্ষা করার জন্যই জন্মস্থান সুরক্ষার দিকটি বিবেচনায় নেয় নি, আর কিছু সর্বদা সুবিধাবাদির দলে অবস্থান নিয়েছিলেন, এব়ং বিদ্রূপ করে তারা যুদ্ধ যাত্রার আগে বলে ছিলেন যা হে গুলি খেয়ে মরবি শালা! বাঁচতে চাস পলায় থাক! অথচ তারা যুদ্ধ পরবর্তীকালে ভুয়া সনদ দিয়ে সর্বোচ্চপর্যায় সরকারী সুবিধা হাসিল করে অবসর প্রাপ্ত হয়েছেন, আউয়াল ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ জন তারাও বামনডাঙার অনেক শ্রদ্ধা ভাজন ব্যাক্তি বর্গ ছিলেন।
সে যাই হোক মোদ্দা কথায় আসি,আউয়াল ভাই সংগীদেরসহ হায়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে, দাদা ভাইয়ের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে BLF গেরিলা মুজিব বাহিনীর এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৯ মাস বিরামহীন ভাবে বাংলার প্রকৃতির সংগে মিশে নানা ধরনের অপারেশন দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন।
এদিকে পরিবারের বড় ছেলে যুদ্ধ কালিন সময়ে নিরুদ্দেশ হলে পুত্র হারা মায়ের কি অবস্থা হয়,তার বিবরন দেয়ার প্রয়োজন আছে কি? একটু অনুধাবন করলেই বুঝা যায়। দীর্ঘ ৯ মাস পর আমরা ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের বড় ভাই সূর্য্য সন্তান এম এ আউয়াল মিয়াকে ,গত মাসেই ছিল আউয়াল ভাইয়ের মৃত্যু বার্ষিকী । অনাড়ম্বরতায় জীবন যাপন করেছেন।একজন স্বনামধন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা বঞ্চিতদের কাতারে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন। অসুবিধা,অপ্রাপ্তির কথা কারো সাথেই শেয়ার করতেন না, পাশাপাশি তোষামোদি চাটুকারিতা এক্কেবারে সহ্য করতে পারতেন না, আমরা কখনো দেখিনি। আমাদের কাছে মাঝে মাঝে মনে হতো ৭১ এর মুজিবাদর্শ লালন করে উনি এখনো BLF কমান্ডার ই আছেন। চাল চলনে সবসময়ই যে টুক ছিল তার মধ্যেই ফিটফাট থাকার চেষ্টায় কোন ত্রুটি ছিল না।
আজ এসব শুধুই স্মৃতি, জীবনের কাছে হেরে যাওয়া এক দেশ মাতৃকার আদর্শ। আরবি তে একটি জনবহুল প্রবাদ আছে,” হুব্বুল ওয়তিন” যে টি কেবল জন্ম ভূমির ভালবাসা থাকলেই সম্ভব। যে আত্নত্যাগ শুধু মাতৃভূমি কে সুরক্ষিত করে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ত্যাগের মহিমায় অর্জিত তাদের আমানতে (স্বাধীনতা)যেন কখনো খেয়ানতের ছোঁয়া না লাগে এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
কতৃপক্ষের নিকট একটি দাবি-এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছিল গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগনজ থানার বামনডাঙা ইউনিয়নের মনিরাম গ্রামে। বর্তমান সরকারের বিচার বিভাগ সম্প্রতি একটি রায় প্রদান করেছেন, দেশে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা রাস্তা স্থাপনা স্বাধীনতা বিরোধী কোন ব্যক্তির নামে থাকা যাবে না,তাই আমাদের এলাকাবাসীর দাবি মুক্তিযোদ্ধা এম এ আউয়াল মিয়ার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা রাস্তার নাম করণ করা হউক।
-শিশির