সীমাহীন নিষ্ঠুরতা

দিলশানা পারুলঃ

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অনেক বড় বড় ব্যর্থতা এবং সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় মানুষ হিসেবে আমাদের নাড়া দিয়ে গেছে। সেটি হচ্ছে মানুষের অমানবিক আচরণ, নিষ্ঠুর মনন। এই রকম একটি প্যানডামিক পরিস্থিতিতে যখন মানুষের পাশে একদল মানুষ সমস্ত কিছু নিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই সময়ই আমরা অন্যরকম একটি চিত্রও দেখতে পেয়েছি।

কোভিড রোগীর চিকিৎসা করার কারনে বাড়িওয়ালা চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত মানুষকে বাড়ি ছারার নোটিশ দিয়েছে, পরিবারের সদস্যের লাশ দরজার বাইরে চার ঘণ্টা পরে থাকার পর মিউনিসিপালটির লোক তার সৎকারের ব্যাবস্থা করতে হয়েছে, মাকে করোনা রোগী মনে হওয়ায় রাতের আধারে গাজীপুর জঙ্গলে ফেলে এসছে, এই রকম আরো অনেক অমানবিক ঘটনা উঠে এসেছে।

আমরা খুব মনকষ্ট নিয়ে ভেবেছি সাধারন মানুষ কেন কেমন করে এমন অমানবিক হয়? কেমন করে এমন অমানবিক হবে? এর চেয়ে ভায়বহ নিষ্ঠুর ক্রিমিনাল এক্ট করতে আমরা দেখেছি এই সমাজেরই মানুষকে। এই কোভিড-১৯ প্যানডামিকের মধ্যেই ৬ বছরের শিশুর ধর্ষণ এর পর ঘার মটকানো লাশ আমরা দেখেছি। শুধু করোনা কালে নয় শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার মতো একটি ভয়াবহ নিষ্ঠুর বিষয়েও আমরা মনে হয় যেন প্রায় অভ্যস্ত হতে চলেছি। ব্রাম্মণবাড়িয়ার দুই গ্রামের মধ্যে ট্যাটা নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ আমার দেখেছি।

শরীর এ ফোঁর ওফোঁর হয়ে যাওয়া ট্যাটা বিদ্ধ একাধিক গ্রাম বাসীর ছবি আমরা দেখেছি প্রচার মাধ্যমে। রানুর কথা মনে আছে আমাদের। একজন মাকে বাচ্চার স্কুলের সামনে শুধূ মাত্র ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে, ইট দিয়ে মাথা থ্যাতলে মেরে ফেলা হয়েছে। এই যে এই ভয়াবহ নিষ্ঠুর বিষয়গুলোর সাথে যুক্ত মানুষগুলো কিন্তু সামাজিক ভারসম্যহীন মানুষ নয়, কিংবা অল্প কয়জন সিরিয়াল কিলার ঘুরে ঘুরে এই ভয়াবহ নিষ্ঠুর ঘটনাগুলোর সাথে যুক্ত বিষয়টা এরকমও নয় । সমাজের সাধারন স্বাভাবিক মানুষগুলোই এই রকম ভয়ংকর নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। খুন ধর্ষণের পরিসংখ্যান বলছে সময়ের সাথে বহু গুন বেরেছে মানুষের এই নিষ্ঠ’রতা।

স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগছে কেন? মায়ের পেট থেকেতো মানুষ এতখানি নিষ্ঠুর হয়ে জন্মায় না, তাহলে? আমাদের পরিবার কাঠামোতেও এমন কিছু পরিবর্তন আসেনি যে সামগ্রিক ভাবে সমাজে নিষ্ঠুর মানুষ এর প্রবাহ আসতে থকবে। তাহলে? আমাদের সামজ এবং রাষ্ট্রে ঠিক কি এমন ঘটনা ঘটছে, কি এমন নিয়ামক তৈরী হয়েছে যার ফলে সামাজিক মানুষ এইরকম নিষ্ঠুর অমানবিক মানুষে পরিনত হচ্ছে?

সমাজ এবং রাষ্ট্র পরষ্পর বিচ্ছিন্ন না। এরা একটা আরেকটার হাত ধরাধরি করে চলে। সমাজ ক্ষমতাশালী হলে রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারে। আর রাষ্ট্র ক্ষমতাশালী হলে সমাজকে প্রভাবিত করে। নিষ্ঠুরতার দুটো পর্যায় আছে একটা সামাজিক বা কমিউনিটি পর্যায় আরেকটা ব্যক্তি পার্যায়ে।

ভক্স্র নিউজ (১ ডিসেম্বর ২০১৯) ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, মনোবিজ্ঞানী পল ব্লুম এর একটি সাক্ষাৎকার ছাপে ‘হোয়াই হিউম্যানস আর ক্রুয়েল’ এই শিরোনামে। সেইখানে পল ব্লুম মানুষের নিষ্ঠুর হওয়ার পিছনে যে প্রক্রিয়াগুলা কাজ করে তার একটি প্রতিষ্ঠিত তত্বের কথা উল্লেখ করেন। মানুষকে সাব হিউমেন হিসেবে দেখার যে প্রক্রিয়া যেই প্রক্রিয়াটার কথা এর মধ্যে আমরা অনেকেই জানি। যেই প্রক্রিয়ায় একটা গোষ্ঠি নিজেদের যখন অপর গোষ্ঠির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা ঠিকঠাক মানুষ ভাবে এবং ধাপে ধাপে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অপর গোষ্ঠিকে কম মানুষ বা মানুষই না এই রকম একটি মনুষ্যত্ব তৈরী করে, তারপর তাদের উপর অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতনকে মনস্তাত্বিক এবং সামাজিক বৈধতা দেয়।

যেই প্রক্রিয়াটা আমরা দেখেছি নাৎসি বাহিনী জিউদের বিরুদ্ধে এবং সাদারা কালোদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করে রেসিয়াল অত্যাচারকে বৈধতা দিয়েছে । প্রফেসর ব্লুম এই সাব হিউমেন মনুষ্যত্ব তৈরীর প্রক্রিয়ার সাথে অর্ধেক একমত। তিনি মনে করেন এই তত্ব অসম্পূর্ণ। তিনি মনে করেন ব্যক্তি মানুষ, অপর মানুষের উপর যে নিষ্ঠুর আচরণ করে এইটার সাথে আসলে মানুষের দুই ধরনের মনস্তত্ব জরিত। একটা হচ্ছে মানুষ যখন অপর মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেতে চায় এবং আরেকটা হচ্ছে মানুষ যখন প্রচন্ড অসহায় বোধ করে। মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার উপায় দুইটা একটা হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে আপনি সম্মান পেতে পারেন অথবা মানুষকে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দিয়ে, মানুষকে দমন পীড়ন করে এক ধরনের সম্মান পেতে পারেন। সম্মান বা ক্ষমতার জন্য যে নিষ্ঠুরতা, বাংলাদেশে বিভিন্ন দলীয় ব্যানারে অথবা টাকার জন্য সংগঠিত নিষ্ঠুরতা আমরা দেখি এবং এই ধরনের নিষ্ঠুরতার প্রতি আমদের এক ধরনের অভ্যস্ততাও তৈরী হয়ে গেছে।

এই নিষ্ঠুরতাগুলোকে মোটা দাগে আমরা চিহ্নিত করতে পারি এবং এর সাথে ক্ষমতা বা সম্মানের সংযোগটা আমরা ধরতে পারি। আমরা এখন পর্যন্ত যে নিষ্ঠ’রতাগুলোর সাথে অভ্যস্ত হতে পারিনি বা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগছে সেইটা হচ্ছে প্রচন্ড অসহায়ত্ব থেকে যে নিষ্ঠুরতার জন্ম হচ্ছে সেইটা। যেমন ক্ষিধার যন্ত্রনায় মা যখন শিশুকে বিক্রি করে দিচ্ছে অথবা পিতা যখন সন্তানকে হত্যা করছে অথবা সন্তান বৃদ্ধা মাকে রেল স্টেশনে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে অথবা জমরি জন্য প্রতিবেশি হত্যা করছে এই ধরনের নিষ্ঠুরতাগুলো আমরা কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। ব্লুম বলছেন মানুষ যখন প্রচন্ড অসহায় বোধ করে তখন আসলে তার অসহায়ত্বের জন্য কোন একজনকে দায়ী করতে চায়, তার যে সমস্ত না পাওয়া, বঞ্চনা, হিউমিলিয়েশন সমস্ত কিছুর জন্য কোন একজনকে দায়ী করে তার উপর শোধ নিতে চায় অথবা তার অসহায়ত্ব এর কারণ থেকে যে কোন ভাবে নিষ্কৃতি পেতে চায়।

ব্লুম সবচেয়ে ইনটারেসটিং যে অবজারভেশন শেয়ার করেছেন, তিনি বলছেন যে কোন মানুষকে আসলে পরিবেশ পরিস্থিতে ফেললে একই রকম নিষ্ঠুর আচরণ করবে। তার মানে যে কোন সমাজে ব্যাক্তির চরম অসাহয়ত্বের পরিমান যখন বারতে থাকবে সেই সমাজে নিষ্ঠুরতার পরিমানও বারতে থাকবে। আবার সমাজে সন্ত্রাস এবং মানুষকে নিপিরন নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যদি সম্মান বা ক্ষমতা অর্জণ করা যায় তাহলে সামজে নিষ্ঠুরতার পরিমান বারতে থাকবে। একক ব্যাক্তি নিষ্ঠুর মানুষ হয়ে জান্মায় না, পরিবশে পরিস্থিতি তাকে হয় নিষ্ঠুর হওয়ার জন্য অসহায় করে অথবা ক্ষমাতায়ন করে। যেই পরিবেশ এবং পরিস্থিতি প্রতক্ষ্য এবং পরোক্ষ্য ভাবে রাষ্ট্রের দ্বারা প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত।

সূত্রঃ সংগৃহিত

-ডিকে

FacebookTwitter