জীবন রেখা

তাহমিদুর রহমান মননঃ

(বর্তমান ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি বসে লেখা এই ফ্যান্টাসি গল্পে আমি যেসব দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি- সেগুলো সত্য। মানুষের সবচেয়ে বড় ভয় ‘মৃত্যুভয়’। এই মূহুর্তে যা আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারে একা পথ চলার সময় ভয় কাটাতে মানুষ যেমন গান ধরে, এই লেখাও আমার তেমনি এক প্রচেষ্টা মাত্র। ভয় তাড়ানী গানের মতো ভয় তাড়ানী গল্প। আপনাদের কেমন লাগলো জানালে উৎসাহিত হবো। সেইসাথে সত্যি হয়তো দূর হবে আমার মৃত্যুভয়।
হোম কোয়ারেন্টিনে সকলের কষ্ট ও ধৈর্য্য স্বার্থক হোক। মৃত্যুর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে জয় হোক জীবনের, জয় হোক মানুষের)

১.
“মোবাইল আনলক করে দাও বাবা।”
ছুটির দিনগুলোতে সেলফোন আমার আট বছরের ছেলের দখলে থাকে। সারাদিন গেম খেলে সে। লক খুলে দিয়ে বললাম- “মাঠে গিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল এসব খেলতে ইচ্ছা করেনা তোমার?”
“না”
এক শব্দে উত্তর দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে মোবাইলে গেম খেলায় ডুবে গেলো সে। এখনকার শিশুরা ভার্চুয়াল পৃথিবীতে বড় হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নাই। তারা ঘুড়ি উড়াতে, লাটিম ঘুরাতে জানেনা। এ কেমন শৈশব? আমাদের শৈশব কেটেছে মাটির সাথে, কেটেছে দুরন্তপনায়। এখন ২০২০ সাল। মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে মানব শৈশব কোথায় থেকে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ?
ছেলের গা ঘেঁসে আমিও উপুড় হয়ে শুয়ে পরলাম।
“এই গেমের নাম কি?”
“কাউন্টার স্ট্রাইক” ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই সে জবাব দিলো। পাগলের মতো স্ক্রিনে আঙ্গুল চেপে গুলি করতে ব্যস্ত সে।
“এখন যদি তুমি গুলি খাও তাহলে গেম ওভার হয়ে যাবে?”
“না। প্রতি রাউন্ডে নতুন লাইফ লাইন আছে…ইশ্ বাবা, তোমার সাথে কথা বলতে গিয়েই একটা গুলি খেলাম। প্লীজ এখন তুমি শুধু দেখো, পরে সব বুঝিয়ে দিবো “
আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার খেলা দেখতে লাগলাম। বাস্তব জীবনেও যদি গেমের মতো এক্সট্রা লাইফ পাওয়া যেতো তাহলে কতো ভালো হতো। ভুলত্রুটি গুলো শুধরে নিয়ে পুনরায় জীবন শুরু করা যেতো। ছোটকাল থেকেই আমার মাথায় আজব আজব সব খেয়াল আসে। এটা কোনো মানসিক সমস্যা কিনা কে জানে। যেমন চুল আঁচরাতে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মনে হয়- আয়নার ভিতরে যে জগৎ দেখতে পাচ্ছি সেটা হয়তো ভিন্ন আরেকটা জগৎ। সায়েন্স ফিকশনের প্যারালাল ইউনিভার্সের মতো। আয়নার মাধ্যমে যে জগতটা শুধু আমরা দেখতে পাই কিন্তু সেখানে প্রবেশ করতে পারিনা। কারন সেটা সম্পুর্ন ভিন্ন মাত্রা বা শূন্য মাত্রার জগৎ অথবা মানুষের চিন্তা-কল্পনার মতো অসীম মাত্রার জগৎ। এমন উদ্ভট সব কথা ভাবতে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজেরই হাসি পায়। কখনো কারো সাথে শেয়ার করিনা- শেষে আমাকে পাগল না ভেবে বসে। আর পাগল ভাবলে আমাকে কেউ চাকরিতে রাখবেনা। তখন এক্সপেন্সিভ এই শহরে পেট চালাবো কিভাবে?
ছুটির দিন সময় খুব দ্রুত যায়। দেখতে দেখতেই দিন শেষ হয়ে গেলো। রাত বারোটার মধ্যে ঘুমাতে হবে, উঠতে হবে সাড়ে ছ’টায়। সাড়ে সাতটার মধ্যে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর যানজটের এই শহরে ভাগ্য
সুপ্রসন্ন থাকলে নয়টার মধ্যে অফিসে পৌঁছাবো। কোনো কোনোদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে নাস্তা না করেই বেরিয়ে যেতে হয়। আর সেদিন যদি যানজটে পড়তে হয় তাহলে সর্বনাশ। এ্যাসিডিটি আর মাথা ব্যথায় কর্মক্ষেত্রে পৌছানোর আগেই সমস্ত কর্মক্ষমতা শেষ। মাঝে মাঝে মনে হয়- এই শহরে হয়তো একদিন এমন বিশাল যানজট তৈরি হবে যা আর কোনদিন খোলা সম্ভব হবেনা। সেটা হলেও ভালো হয়। সবাই তখন পায়ে হেঁটে চলাচল করবে। গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ। বায়ুদূষণ নাই।
ভাবছি এবার ছুটিতে বাড়ি থেকে আমার বাইক’টা নিয়ে আসবো। এই শহরের রাস্তায় দুই চাকার গাড়িই শুধু সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে।
বরো তলা টাওয়ারের আট তলায় আমার অফিস। যদি কোনোদিন লিফটের মধ্যে একা থাকি আর মাঝপথে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়ে সেটা থেমে যায়। নিকষ অন্ধকারে দম আটকে আসে। পাঁচমিনিট সময়কে পাঁচ ঘন্টার মতো মনে হয়। তখন আজব আজব খেয়াল আসে মাথায়। এক দিনের ঘটনা বলি- ওঠার সময় মাঝপথে লিফট আটকে গেলো। সেদিন আমি একা ছিলাম না, সাথে ছিলো আমার কলিগ আনিস ভাই। অন্ধকার দূর করতে মোবাইলের আলো জ্বাললাম দুজনেই। আমি বললাম- “আনিস ভাই, এখন যদি এমন হয়- লিফট চালু হওয়ার পর উপরে উঠতেই আছে- উঠতেই আছে আর থামেনা। বহুক্ষন পর থামলো এবং দরজা খুলে গেলো। বের হয়ে দেখলাম সেটা সম্পুর্ন নতুন একটা ফ্লোর। ধরুন আট তলার বদলে সেখানে লেখা আছে একশ আট তলা। যেখানে হুবহু আমাদের অফিসের মতোই একটা অফিস আছে। যেখানে বস এবং বাঁকি কলিগরা সহ আমরা দুজনও আগে থেকেই এসে বসে আছি। মানে হুবহু আমাদের মতো দেখতে আরো দুজন। তারা প্রত্যেকে বিস্মিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে…তখন কি করবেন আপনি?”
মুখ হা করে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন আনিস ভাই। এবার তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো-
“কি বলেন আপনি এইসব? গাঁজা-টাজা খাইছেন নাকি?”
আমি ভিষণ লজ্জা পেলাম। এই ধরনের উদ্ভট কল্পনার বিষয়টা অন্য কারো সাথে সেয়ার করার ঘটনা আমার সেটাই প্রথম, সেটাই শেষ।

২.
অফিসে ঢুকে থমকে গেলাম। বসের রুমে বসে আছেন স্থানীয় থানার ওসি। চিন্তিত মুখে তার সাথে কথা বলছেন বস। বাঁকি কলিগদের মুখে কোন কথা নাই। থমথমে পরিবেশ। ঘন্টা খানেক আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমাদের অফিসের এসি গুলো পুরনো হওয়াতে মাঝেমধ্যেই ডিস্টার্ব দিচ্ছিলো। সেগুলো বদলিয়ে নতুন এসি লাগানোর কাজ চলছিলো। সেই কাজ করতে গিয়ে আট তলা থেকে নীচে পড়ে মারা গেছে একজন কর্মী। স্পট ডেথ। শুনে মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেলো আমার। আহারে বেচারা। পেটের দায়ে পরিবার ছেড়ে এসে এই শহরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কতো দুঃসাহসিক কাজই না করতে হয় মানুষকে। তাদের না আছে কোনো উন্নত নিরাপত্তা সরঞ্জাম, না আছে দুর্ঘটনা বীমা।
মৃত ব্যক্তি যে এজেন্সির হয়ে কাজ করছিলো সেই এজেন্সির মালিক এসে হাজির হলেন। তার অভিযোগ- এই বিল্ডিং এর ডিজাইনে আর্কিটেক্ট এসি’র কমপ্রেশর সেট করার জন্য কোনো জায়গা রাখেনি। ফলে প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তার কর্মীদের। এজেন্সি মালিকের অভিযোগ সত্য। যদিও এই কথা বলে তিনি তার নিজের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাতে কি? ভুল বা দোষটা যারই হোক, মৃত মানুষটা তো আর ফিরে আসবেনা। ভাবতে অবাক লাগে- একজনের ছোট্ট একটা ভুল কিভাবে অন্য আরেক জন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দুর্ঘটনায় মৃত মানুষ দেখলে খুব কষ্ট হয় কিন্তু তবু্ও কৌতুহল দমিয়ে রাখা যায়না। লাশ দেখতে নীচে বিল্ডিংয়ের পিছনে গেলাম। দুমড়ে মুচড়ে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে পড়ে আছে দেহটা। শুনলাম জানালার সানসেডে বসে কাজ শেষ করে ছাদ থেকে ঝুলানো দড়ি বেয়ে নামার সময় হাত ফসকে নীচে পড়ে যায় সে। লাশের মুখটা দেখা মাত্র চিনতে পারলাম। গতপরশু দিনই পরিচয় হয়েছিলো। ছেলেটা হিন্দু। বয়স আনুমানিক পঁচিশ। পরিচয় হওয়ার কারন- চমৎকার গানের গলা ছিলো ছেলেটার। মুখটা সবসময় হাসি হাসি। গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে অফিসের ভিতরে কাজ করছিলো গতকাল। আমি বললাম- “বাহ্, তোমার গানের গলা তো চমৎকার !”
“সবই আপনাদের আশির্বাদ স্যার” তারপর কন্ঠস্বর নিচু করে বললো-” এইডা অফিস দেইখা জোরে গাইতে পারতেছি না। আমার গলার ভলিওম আরো বেশি।”
“সবসময় বেশ ফুর্তিতে থাকো মনে হচ্ছে”
পাশ থেকে তার এক সহকর্মী বললো- ” ফুর্তিতে তো থাকবোই স্যার, গেলো মাসেই বিয়া করছে। সুন্দরী বউ।”
আমি জানতে চাইলাম- “বিল্ডিংয়ের বাইরের দিকটাতে কাজ করার জন্য তোমাদের নিরাপত্তার সরঞ্জাম কি আছে?”
গান গাইতে গাইতেই হাতের ইশারায় মেঝেতে ফেলে রাখা একগাছা মোটা পাটের দড়ি দেখালো ছেলেটা।
“সর্বনাশ, শুধু একটা দড়ি?! মৃত্যুর ভয় নাই তোমাদের?”
“ভয় কইরা কি হইবো স্যার? ভগবান যহন যেইহানে মরন লেইখ্যা রাখছে, হইবো। জন্ম, মৃত্যু আর বিয়া, এই তিনডা ভাইগ্যের লিখন। খন্ডান যায়না।…আমার বিয়ার ভাইগ্য খুবই ভালা স্যার। আফনের বউমা লেহাপড়া জানে। ম্যাট্রিক পাশ। অত্যান্ত বুদ্ধিমতী।”
আমি ঝুঁকে পড়ে লাশের মুখটা ভালো করে দেখলাম। সেই মুখে এখন হাসির জায়গায় অসহনীয় যন্ত্রনার ছাপ সুস্পষ্ট। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠলো আমার।
সেইসাথে মনের মধ্যে ভিড় করতে থাকলো অদ্ভুত সব খেয়াল। হিন্দুরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। পুনর্জীবন বিষয়টা যদি সত্যিই থাকে তাহলে লজিক্যালি সেটা কিভাবে সম্ভব? এই মহাবিশ্ব কি শুধুই লজিক নির্ভর? দুর্ঘটনার মৃত্যুও কি পূর্ব নির্ধারিত, ভাগ্যের লিখন? তা কেনো হবে? তা-ই যদি হবে তাহলে মানুষকে এতো বিচারবুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করে কি লাভ? বয়স জনিত কারণে মৃত্যুর বিষয়টা পূর্ব নির্ধারিত হতে পারে কিন্তু দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে হয়তো সম্পুর্ন ঘটনা ঘটে যা আমরা জানতে পারিনা। হতে পারে যখন কেউ যে মূহুর্তে দুর্ঘটনার শিকার হয় ঠিক সেই মূহুর্তে সেই মানুষটার অস্তিত্ব এবং তার জীবন রেখা দুটো ভিন্ন সময়ের জগতে ভাগ হয়ে যায়। অনেকটা গাছের কান্ড থেকে শাখা, শাখা থেকে প্রশাখার মতো পাশাপাশি চলতে শুরু করে ভিন্ন দুটো জীবন। অর্থাৎ যেই মূহুর্তে
এই ছেলেটা নীচে এসে পড়েছে সেই মূহুর্তে মহাজাগতিক সময় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক জগতে ছেলেটার ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে, যে জগতে দাঁড়িয়ে আছি এই আমি। আরেক জগতে ছেলেটার মৃত্যু হয়নি। তাকে দ্রুত হাসপালে নেয়া হয়েছে এবং সে বেঁচে আছে। অন্যান্য সমস্ত কিছুর মতো আমিও আছি সেই জগতে। ছেলেটাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছি। শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রনা সত্বেও সে মুখে হাসি এনে বলছে- ” কইছিলামনা স্যার, জন্ম-মৃত্যু ভগবানের হাতে। দ্যাহেন আটতলা থাইকা নিচে পইরাও বাঁইচা আছি”
আবার এমনটাও হতে পারে- অন্য জগতে এই ছেলের জীবন শুরু হয়েছে তার শৈশব কিংবা কৈশোরের কোনো একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে। ভিডিও গেমের মতো কোনো প্রিভিয়াস লেভেল থেকে… আমি আর বেশি ভাবতে পারলামনা। মাথার মধ্যে এক ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজের এমন উদ্ভট চিন্তার জালে নিজেই জট পাকিয়ে যাই।
খবর পেয়ে বাড়ি থেকে মৃত ছেলেটার কাকা এসেছে আমাদের অফিসে। সাথে এসেছে ছেলেটার নতুন বউ। খুব অল্প বয়সের একটা মেয়ে। হালকা পাতলা গড়ন। চেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে নির্বাক তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তার চোখে জল নাই। কথায় আছে- ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’
আমার বস মানুষটা দয়াবান। তিনি মেয়েটাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলেন। ক্ষতিপুরন হিসাবে এজেন্সির মালিকও দিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। ভবিষ্যত আইন-আদালতের ঝামেলা এড়াতে একটা দেড়’শ টাকার স্ট্যাম্পে টাকার পরিমান উল্লেখ করে তাতে তাদের সই নেয়া হলো। টাকাগুলো মেয়েটার হাতে দেয়ার সময় ছবি তুলে রাখা হলো। বিষন্ন চোখে আমি সমস্ত ঘটনা দেখলাম। আমি জানলাম- আমাদের এই চেনা পৃথিবীতে মৃত মানুষটার জীবনের মূল্য এক লক্ষ টাকা।

৩.
বৃহস্পতিবার রাতের বাসে বাড়ি রওনা হলাম। শনিবার একদিনের ছুটি নিয়েছি। অফিসে যাতায়াতের জন্য আমার বাইকটা ঢাকায় নিয়ে আসবো এবার।
বাড়ি পৌছলাম ভোর বেলা। তখনো অন্ধকার কাটেনি। বাড়িতে এসে ডোরবেলের সুইচ চাপার সময় মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যদি এমন হতো- ডোরবেল বাজার সাথে সাথে আগের মতো ভিতর থেকে বাবা-মা একসাথে বলে উঠলো- “কে? খোকা?” আমি বাড়ি আসছি জানলে রাতে তাদের ঘুম হতোনা। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত এসে দরজা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরতো বাবা। তার পিছে দাঁড়িয়ে থাকতো মা। আমি তাকে জড়িয়ে ধরতাম। বাবা-মা’র কাছে সন্তান চিরকাল শিশুই থাকে।
চোখ ভিজে উঠলো আমার। আর কোনোদিন ডোরবেলের আওয়াজে তাদের মমতা মাখানো কন্ঠস্বর ভেসে আসবেনা। বছর চারেক আগে হার্ট স্ট্রোকে মারা গেছে বাবা। একবছর আগে মা। গলায় ক্যানসার হয়েছিলো তার। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো তাদের জীবনের শেষ সময় কাছে থেকে সেবা করবো। কিন্তু নিজের সন্তান, সংসার আর পেশার কারনে আমি তা করতে পারিনি। সেজন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়। বাড়িতে আসতে ইচ্ছা করেনা আর। মনে মনে বাবা-মা’র উদ্দেশ্যে বললাম- “তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
রাস্তার ক্লান্তি দূর করতে গোসল সারতে টিউবওয়েলের পাড়ে এসে দাড়ালাম। বহু বছরের পুরনো টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলে ক্ষয়ে যাওয়া অংশটা যেনো মা’য়ের হাতের স্পর্শ ধারে রেখেছে এখনও। শান বাঁধানো মেঝেটা খাড়া ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের ভিতর দিকে একটা পেয়ারা গাছ। জন্মের পর থেকে গাছটাকে এতো বড়ই দেখে আসছি। এটার বয়স কতো হবে জানিনা। শুনেছি আমার দাদীর মা গাছটা লাগিয়ে ছিলেন। পেয়ারা গাছ কতোদিন বাঁচে? গাছের প্রাণ আছে জানি কিন্তু গাছের স্মৃতি
আছে কিনা জানিনা। এই গাছটা কি আমাকে চিনতে পারছে এই মূহুর্তে? এমন হতেও তো পারে। রহস্যময় এই দুনিয়ার কতটুকু জানতে পেরেছি আমরা? জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত গাছেরও যে প্রাণ আছে সেটাও তো জানতোনা মানুষ। কোনো একদিন কেউ হয়তো প্রমান করে দিবে- গাছের স্মৃতিও আছে। ভাবতে ভাবতে গাছটার গায়ে হাত রাখলাম। পেয়ারা গাছের চামড়া দেখতে অনেকটা মানুষের চামড়ার মতো। চোখে পড়লো গাছের এক জায়গায় গভীর দাগ কেটে T+S লেখা আছে। ছেলেবেলায় আম কাটা চাকু দিয়ে আমিই লিখেছিলাম। আমার নামের প্রথম অক্ষর T আর, S অর্থাৎ শাহানা। স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠলো চল্লিশ বছর আগের কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনার ছবি। তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। দুরন্ত স্বভাবের ছেলে ছিলাম। নদীতে সাঁতার কাটা, ঘুড়ি উড়ানো, লাটিম ঘুরানো, গুলতি দিয়ে পাখি মারা, আম পাড়া, মানুষের বাগান থেকে ফুল চুরি করা- ইত্যাদি কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলাম। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা একসাথে খেলতাম। হরেক রকমের খেলা- ছি-বুড়ি, গাদল, এক্কাদোক্কা, লুকোচুরি এইসব। কখনো মাঠে খেলতাম কখনো বাড়ির আশেপাশের গলিতে। আমাদের বাড়ির অদূরে একটা হলুদ রঙের দ্বোতলা বাড়ি ছিলো যা এখন আর নেই। সে জায়গায় নতুন বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। তখন বাড়িওয়ালা থাকতো দ্বোতলায়। নিচতলায় স্বপরিবারে ভাড়া থাকতো একজন সরকারি কর্মকর্তা। তার ছিলো দুই মেয়ে। কেকা আর এলিনা। কেকা বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড় আর এলিনা ছিলো আমার সমবয়সী। দু’জনেই খেলার সাথী।
একবার গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে তাদের বাড়িতে এলো তাদের এক খালাতো বোন। নাম শাহানা। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। মেয়েটাকে দেখামাত্র মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। হরিনীর মতো মায়াভরা চোখ। হালকা-পাতলা গড়ন। শাদা ফিতা দিয়ে ঝুঁটি বাঁধা চুল। পরনে গোলাপী ফ্রক। ঠিক যেনো রূপকথার রাজকন্যা ! খুব কম কথা বলে। পরিচয় পর্ব শেষে আমাদের খেলার দলে যোগ দিলো শাহানা। শুরু হলো একসাথে খেলা আর আড্ডা দেয়া। শাহানাই ছিলো আমার জীবনের প্রথম ক্রাশ। তার সাথে পরিচয়ের দিনে একটা দুঃসংবাদও পেলাম। শুনলাম কেকার বাবা গাইবান্ধায় বদলি হয়ে গেছে। অল্প দিনের মধ্যেই তারা এই শহর ছেড়ে চলে যাবে।
পোষাক পরিচ্ছদে আগে থেকেই পরিপাটি ছিলাম আমি। শুরু হলো চেহারার বাড়তি যত্ন নেয়া। বিভিন্ন কায়দায় শাহানাকে ইমপ্রেশ করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমি। যেমন- ওর জন্য কাঁচা আম পেড়ে আনা, ফুল চুরি করে আনা, নিজে না খেয়ে ওকে চকলেট খেতে দেয়া…ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েটাও যে আমাকে পছন্দ করে সেটা তার চাহুনি দেখে বুঝতে পারি। আমাকে দেখামাত্র তার ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসির রেখা ফুটে ওঠে। যে হাসির অর্থ সবাই বোঝে। দলগত আড্ডায় সব সময় সে আমার পাশে বসে। আমার ধারনা ভুল না হলে- একটু যেনো বেশিই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। লুকোচুরি খেলার সময় শাহানা নিজে থেকে কোনো লুকানোর জায়গা খুঁজে পায়না। প্রতিবার আমি যেখানে লুকাই সেও সেখানে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। এরকম অবস্থায় একদিন আমি দুঃসাহসিক এক কান্ড করে বসলাম। দু’জনেই লুকিয়েছি সিঁড়ির নিচের আবছা অন্ধকারে।
আমি আচমকা শাহানার গালে একটা চুমু দিলাম। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো ওর ফর্সা মুখ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। ভয় পেলাম আমি। বড়দেরকে বলে দিবে না তো? কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থেকে আমাকে অবাক করে দিয়ে শাহানা আমার গালে একটা চুমু খেয়ে দৌড়ে পালালো। অপূর্ব আনন্দে সে রাতে ঘুম এলোনা আমার। সকালে কোনোমতে পড়া শেষ করে বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে বাইরে বের হলাম। দেখলাম বারান্দার সিঁড়িতে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদছে শাহানা। ওকে এই অবস্থায় দেখে বুকটা ভেঙে গেলো আমার। বললাম- “কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেনো?”
“কিছুনা”
“কিছু তো অবশ্যই হয়েছে। এমনি এমনি কেউ কাঁদে?”
শাহানা কোনো কথা বললোনা। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো কেকা। সে বললো- “এলিনা ওর হাত থেকে পেয়ারা কেড়ে নিয়েছে। সেজন্য কাঁদছে।”
সেই কথা শোনামাত্র আমি সেদিন এই পেয়ারা গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। উপরে তাকিয়ে দেখলাম- একটাও ভালো পেয়ারা হাতের নাগালে নাই। একেবারে মগডালে বড় একটা পেয়ারা চোখে পড়লো। গাছে উঠলাম আমি। যেভাবেই হোক শাহানার জন্য ওটা পাড়তে হবে। অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে মগডালে উঠে কোনো অঘটন ছাড়াই পেয়ারাটা পাড়লাম। কিন্তু সেটা হাতে নিয়ে নামার সময় একটা মরা ডালে পা রাখতেই মড়াৎ শব্দে ডালটা ভেঙ্গে গেলো। পনেরো ফুট উপর থেকে সোজা শানের মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম আমি। টিউবওয়েল আর প্রাচীরের মাঝখানে মাত্র এক হাত জায়গার মধ্যে। বাম হাতটা পড়লো পিঠের নিচে। আচমকা প্রচন্ড ঝাঁকুনি খাওয়াতে আমার ফুসফুস কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। আমার দৃষ্টি দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসছে। উঠানে মাছ কাটছিলো দাদী। অস্পষ্ট চোখের কোনা দিয়ে তাকে চিৎকার করে আমার দিকে ছুটে আসতে দেখলাম। তখনই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো।
আধা ঘণ্টা পরে জ্ঞান ফিরলো আমার। চোখ মেলে দেখলাম বারান্দায় মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আত্মীয়-স্বজনরা। আমার বাম হাতের কব্জিতে একটা ভিজা গামছা জড়ানো। কব্জিতে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। সবকিছু মনে করতে কিছুটা সময় লাগলো আমার। তারপর বলে উঠলাম- ” আমার হাতে একটা পেয়ারা ছিলো, সেটা কোথায়?”
আমার জ্ঞান না ফিরাতে এতোক্ষন দুশ্চিন্তায় ছিলো বাবা।এবার নিশ্চিন্ত হয়ে উত্তরে ধমক লাগালো সে- “এক চড় দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দিবো। সামান্য পেয়ারার জন্য তো মরতে বসেছিলি?”
চুপ করে রইলাম আমি। পেয়ারাটা যে মোটেও সামান্য নয়- সেটা তাকে কিভাবে বোঝাবো? পাশ থেকে দাদী বললো- “শুধু মায়ের দুধের জোরে তুই আজ বেঁচে গেছিস। আর আধ হাত এদিকওদিক হলে তোকে আর পেতামনা। আল্লাহ নিজ হাতে বাঁচিয়েছেন।”
মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার ছোটো বোন। পেয়ারাটা তার হাতে। সে ভয়ে ভয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো- “এই নাও তোমার পেয়ারা”
এক্স-রে রিপোর্টে দেখা গেলো আমার বাম হাতের দুটো হাড়ের একটা কব্জির জয়েন্ট থেকে খুলে আধা ইঞ্চি দূরে সরে গেছে। সেই হাড় পুনরায় আগের জায়গায় সেট করতে যে কি ভয়াবহ যন্ত্রণা হলো তা বলে বোঝাতে পারবোনা। দুই চোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে জল নামলো আমার। দাঁতে দাঁত চেপে আমি তা সহ্য করলাম। মুখ বুঁজে যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা আমার জন্মগত।
হসপিটাল থেকে হাতে প্লাস্টার নিয়ে বাড়ি ফিরার পর কেকা, এলিনা, শাহানা তিনজনই আমাকে দেখতে এলো। আমি শাহানাকে পেয়ারাটা দিলাম। সেটা হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। তার চোখে পানি টলটল করছে। কেকা বললো- “কাল সকালে আমরা গাইবান্ধা চলে যাচ্ছি।”
লক্ষ করলাম- তাদের তিন জনেরই চোখ ভেজা। আমারও গলা ধরে এলো। শাহানার দিকে তাকিয়ে বললাম- “যাওয়ার আগে একবার আমার সাথে দেখা করে যেও তোমরা।”
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এগারোটা বাজে। মা’কে জিজ্ঞেস করলাম- “কেকারা কি চলে গেছে মা?”
মা বললো- “হ্যাঁ। সকালে অবশ্য ওরা এসেছিলো। হাতের ব্যাথার জন্য ডাক্তার ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। সেজন্য ঘুম থেকে তোকে ডেকে তুলিনি”
মা’র কথা শুনে আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। নির্বাক হয়ে বসে রইলাম।
জীবনের প্রথম প্রেম কাহিনি আমার সেখানেই শেষ। ওদের নতুন ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার নেয়া হয়েছিলোনা বলে পরে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। শাহানার সাথে সেই ছিলো দেখা। তারপর চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমাদের। শুধু দুরন্ত শৈশবের সাক্ষী হয়ে পেয়ারা গাছটা দাঁড়িয়ে আছে আজও।

৪.
শুক্রবার সকাল। জানুয়ারীর তিন তারিখ, ২০২০ সাল।
বেশ শীত পড়েছে আজ। মোটর বাইকটা বের করে পানি দিয়ে পরিস্কার করলাম। দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় সেটাকে স্টার্ট করে বুঝলাম- সার্ভিসিং করাতে হবে। বহুদিন ব্যবহার না করাতে ইঞ্জিনে ময়লা জমেছে। তাছাড়া ফুয়েল ভরতে হবে। দু-চারজন বাল্যবন্ধুদের সাথে দেখা করবো ঠিক করে সকাল সকাল বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হেলমেটটা খুঁজে পেলামনা কোথাও। ছুটির দিনে বিকালের আগে রাস্তায় খুব একটা যানবাহনের ভিড় থাকেনা। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাইক চালাচ্ছি আমি। এই রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট, মানুষ-জন, পশু-পাখি, বাড়ি-ঘর, গাছপালা সবকিছুই আমার চির আপন, চির চেনা। এখানে এলে আর ঢাকায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করেনা। পৌরসভা গোরস্থানটা রাস্তার পাশেই। সেখানে নেমে বাবা-মা’র কবর জিয়ারত করে পুনরায় রাস্তায় উঠে এলাম। ভাবতে থাকলাম- মানুষের আত্মা কি তার কবরের কাছে ফিরে ফিরে আসে? আমার বাবা-মায়ের আত্মা কি আজ আমাকে দেখতে পেলো? আত্মা জিনিসটা আসলে কি রকম? এই জগতে দুটো জিনিস আছে। বস্তু আর শক্তি। আমাদের শরীরকে বস্তু এবং আর আত্মাকে শক্তির সাথে কি তুলনা করা যায়? আমার এই বাইকটার কথাই ধরা যাক, যতক্ষন এটাকে চালু করতে পারছিলাম না ততোক্ষণ এটা মৃত ছিলো। ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়ামাত্র এটার বস্তুগত শরীরে শক্তি বা আত্মার সঞ্চার হলো। তারপর থেকে বাইকটা চলাফেরা করছে, শব্দ করছে, এমনকি পালস্ও আছে এটার। আবার ইঞ্জিন বন্ধ করলে বা বিকল হয়ে গেলে মৃতদেহের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে যায় বাইকটা। পদার্থ, শক্তি দুটোরই শুধু রূপান্তর আছে, বিনাশ নাই কোনো। একই নিয়মে হয়তো আমাদের আত্মার বিনাশ হয়না কখনো। এক জগত থেকে আরেক জগতে স্থানান্তরিত হয় শুধু। চেনা মাত্রার জগত থেকে অচেনা মাত্রার জগতে। এইসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো- সামনেই রাস্তার পাশে এক বাল্যবন্ধুর দোকান আছে। তার সাথে খানিকক্ষন আড্ডা দিবো মনে করে রাইট টার্নিং সিগনাল দিলাম। সিগনাল লাইটের সাথে সাথে সাইরেনও বাজে আমার বাইকে। কিন্তু ভুলে গেলাম এটা রাজধানী না, মফস্বল শহর। এখানকার গাড়ি চালকদের হাত নেড়ে সিগনাল না দেয়া পর্যন্ত প্রতিপক্ষের গতিবিধি বুঝতে পারেনা এরা। ডানদিকে টার্ন নেয়ার পর লক্ষ্য করলাম সামনে থেকে একটা সিএনজি আমার খুব কাছে চলে এসেছে। সেটা ব্রেক করলো শেষ মূহুর্তে। ততোক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। জোর গতিতে এসে সিএনজিটা আমার বাইকে আঘাত করলো। আমার শরীর ডাইভ দেয়ার ভঙ্গিতে উড়ে গেলো। গাড়ির উপরের কোনো অংশে মাথাটা প্রচন্ড জোরে ঠুকে গেলো। আমি উপুড় হয়ে পড়লাম রাস্তার উপর। কপাল বেয়ে গরম রক্তের ধারা আমার মুখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম নাক আর কান দিয়েও রক্ত বেরোচ্ছে। মাথায় কোনো রকম যন্ত্রণা অনুভব করছিনা আমি। শুধু দম আটকে যাওয়ায় কষ্ট পাচ্ছি। কোনোভাবেই নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। আমি কি মরে যাচ্ছি? সেই সময় হঠাৎ অপার্থৃব সুন্দর একটা গন্ধ যেনো আমার নাকে এলো। তখনই দপ্ করে অন্ধকার হয়ে গেলো আমার পৃথিবী।
আচমকা ঘুম ভাঙার মতো চোখ মেলে তাকালাম আমি।
দেখলাম- আমাদের বাড়ির বারান্দায় মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি আমি। খুব পরিচিত অথচ অচেনা একটা সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি। আমার চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আমার বাবা, দাদী সহ আত্মীয়-স্বজনরা। বাম হাতে ব্যথা অনুভব করায় তাকিয়ে দেখলাম- কব্জিতে একটা ভেজা গামছা জড়ানো। এ আমি কোথায় আছি? স্বপ্ন দেখছিনাতো? নিজের ঠোঁটে জোরে করে কামড় দিলাম। না এটা স্বপ্ন নয়, জলজ্যান্ত বাস্তব ! একই সাথে দুইটা দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ছে আমার। প্রথমটা সিএনজি’র সাথে আমার বাইক এ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা, দ্বিতীয়টা পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। কোনটা সত্য? না কি দুটোই সত্য? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সত্য একই সময়ে দুই রকম কিভাবে হয়? আর ভাবতে পারলামনা আমি। মাথার মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের যন্ত্রনা হচ্ছে। চোখের সামনের বাস্তবতাকে আপাতত সত্য মেনে জানতে চাইলাম- ” মা, এটা ইংরেজি কতো সাল?”
মা আমার কপালে হাত বুলিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো- “উনিশ’শ আশি সাল ! কেনো রে, তুই মনে করতে পারছিসনা?”
মা ভাবছে- দুর্ঘটনার কারনে মাথায় আঘাত পেয়ে তার ছেলে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেলো কিনা। তাকে আস্বস্ত করতে আমি মুচকি হেসে বললাম- “এবার সব মনে পড়েছে মা”
তারপর বললাম- “আমার হাতে একটা পেয়ারা ছিলো, সেটা কোথায়?”
শুনে বাবা বললো- “এক চড় দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দিবো। সামান্য একটা পেয়ারার জন্য তো মরতে বসেছিলি।”
পাশ থেকে দাদী বললো- “শুধু মায়ের দুধের জোড়ে আজ তুই বেঁচে গেছিস। মাত্র আধ হাত এদিক-ওদিক হলেই তোকে আর পেতামনা। আল্লাহ নিজ হাতে বাঁচিয়েছেন”
মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার ছোটো বোন। সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো- “এই নাও তোমার পেয়ারা”
একের পর এক ঘটনাগুলো এমন ভাবে ঘটছে যেনো আমি একই সিনেমার দৃশ্যগুলো দ্বিতীয় বার দেখছি। পেয়ারাটা হাতে নিয়ে আবারও মুচকি হাসলাম আমি। আনন্দ আর রহস্যের হাসি।
বিকালে হাতে প্লাস্টার নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলাম। আমাকে দেখতে এলো কেকা, এলিনা আর শাহানা। কেকা বললো- “আমরা কাল সকালে গাইবান্ধা চলে যাচ্ছি”
আমি পেয়ারাটা শাহানার হাতে দিলাম। ওদের সবার চোখ ছলছল করছে। সব কথার শেষে অামি কেকাকে বললাম- ” কাল সকালে আসার সময় তোমাদের নতুন ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বার একটা কাগজে লিখে নিয়ে এসো অবশ্যই। মাঝে মাঝে চিঠি লিখা যাবে। ইচ্ছে হলে কথাও বলতে পারবো”
তিনজন একসাথে ঘাড় কাত করলো- “ঠিক আছে”
রাতে খাওয়ার পর মা আমার হাতের তালুতে একটা ক্যাপসুল আর দুইটা ট্যাবলেট রেখে বললো- “এগুলো ধরে থাক, আমি পানি নিয়ে আসি”
আমি বললাম- “এর মধ্যে ঘুমের ঔষধ কোনটা মা?”
“কেনো রে?”
“আহা বলোনা তুমি”
চিনিয়ে দিয়ে মা ঘর থেকে বেরোতেই আমি ঘুমের ট্যাবলেট খাটের নিচে ফেলে দিলাম। কারন কাল খুব সকালে আমাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে।
রাতে আমার ছোটো বোন দাদীর কাছে ঘুমাতে গেলো। বহুদিন পর আজ আবার বাবা-মার মাঝখানে শোবার সুযোগ পেলাম আমি। এটাই হচ্ছে অসুস্থতার লাভজনক দিক। ঘুমানোর আগে মা আমার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললো- “আমাকে কথা দে- তুই আর কখনো গাছে উঠবিনা”
এটাই মোক্ষম সুযোগ বুঝে আমি বললাম- “কথা দিতে পারি একটা শর্তে, তোমাদের দু’জনকেও আমার একটা কথা রাখতে হবে। বলো রাজি আছো?”
পাশে শুয়ে থাকা বাবা বললো- “তোর ভালোর জন্যই কথাটা কিন্তু কথাটা বলা হচ্ছে তোকে”
“আমিও তোমাদের ভালোর জন্যই বলবো”
“বল, শুনি কি শর্ত”
“সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবে তুমি। আর মা’কে জর্দা দিয়ে পান খাওয়া ছাড়তে হবে। শুধু পান খেতে পারো অবশ্য, জর্দা বাদ”
কিছুক্ষন গাঁইগুঁই করলেও শেষ পর্যন্ত তারা দুজনেই সিগারেট আর জর্দা ছেড়ে দিবে বলে আমাকে কথা দিলো। আমিও তাদেরকে কথা দিলাম- আর কখনো গাছে উঠবোনা।
বাবা-মা ঘুমানোর পরেও বেশ কিছুক্ষণ জেগে রইলাম আমি। একে একে স্মৃতিতে ভেসে উঠছে ভবিষতের সমস্ত কথা। ২০২০ সাল পর্যন্ত আমার জীবনের সমস্ত ঘটনার ছবি। একই সাথে দুইটা স্মৃতি আমার। একটা অতীতের স্মৃতি, আরেকটা ভবিষ্যতের স্মৃতি।
খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। চোখে পড়লো অসংখ্য তারা ভরা রাতের আকাশ। হালকা চাঁদের আলোয় ছেঁড়া ছেঁড়া শাদা মেঘ বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। প্রকৃতি তার অসীম রহস্যের চাদরমুড়ি দিয়েই থাকবে অনন্ত কাল। পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ সে কখনোই করবেনা। গোপনীয়তার মাঝেই নিহিত তার সকল সৌন্দর্য। প্রকৃতির উপর অন্য কারো কোনো নিয়ন্ত্রন নাই।
সে স্বনিয়ন্ত্রিত, স্বাধীন চেতা, নিজেই নিজের স্রষ্টা। তার কাছে অবস্যম্ভাবি বলে কিছু নাই, অসম্ভব বলেও কিছু নাই।

FacebookTwitter