কুমার বিশ্বজিৎ, গায়কঃ
১৯৭৭ সাল। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। চট্টগ্রামের জুবিলি রোডে বাচ্চু আর আমি পাশাপাশি বাসায় থাকি। বন্ধুরা মিলে তখন ‘রিদম ৭৭’ নামে একটি ব্যান্ড গড়ে তুলি। বাচ্চু তখন আমাদের ব্যান্ডেও বাজাতে শুরু করে।
কলেজে উঠে ‘ফিলিংস’ গড়ার সময় আমি তাকে নিয়ে আসি। তখন আমরা বেশি করতাম ইংরেজি ইনস্ট্রুমেন্টাল। আগ্রাবাদ হোটেলে প্রথম শো করে ‘ফিলিংস’। দীর্ঘদিন আমরা সেখানে গান করেছি। মূলত বিদেশি অতিথিরাই আমাদের শো বেশি উপভোগ করতেন। বলা যায় তখন থেকেই ওয়েস্টার্ন ঘরানার গিটার বাজাতে শুরু করে বাচ্চু। মনে পড়ে দুজন তখন রাত করে বাসায় ফিরতাম। মা আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন। আর আদর করে বলতেন, আমার দুই ছেলে!
বাসার পাশেই ছিল আমাদের আরেক বন্ধু [‘রিদম ৭৭’ ব্যান্ডের সদস্য] উত্তমের মিষ্টির দোকান। প্রতিদিন আমরা সেখানে আড্ডা দিতাম। শিঙাড়া খেতাম, মিষ্টি খেতাম, তারপর দল বেঁধে প্র্যাকটিসে যেতাম। এই আড্ডা ছিল আমাদের জন্য একটা উৎসব।
প্র্যাকটিসের ওখানে আশপাশের অনেকে ঢিল মারত, বিকৃত স্বরে চিল্লাচিল্লি করত। আমরা বিছানার জাজিম দিয়ে সাউন্ড আটকে কাজ করতাম। বলা যায়, প্রায় চুরি করেই প্র্যাকটিস সারতাম।
১৯৭৮ সালের একটি ঘটনা বলি। বাচ্চু, এবং আরও তিন বন্ধুসহ আমরা ঢাকায় এসে এক হোটেলে উঠি। সে সময় আমাদের হাতে তেমন টাকা-পয়সা থাকত না। সবার নাশতার জন্য মাত্র এক প্লেট ভাজি আনা হয়। সেই ভাজিটা মাটিতে পড়ে গেলে আমাদের খুব মন খারাপ হয়। পরে মাটি থেকে তুলেই আমরা ভাজিটা খেয়েছি। ঐশ্বর্যের মধ্যে বড় হলেও সংগীতের টানে আমরা সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে সৃষ্টির পেছনে ছুটেছি প্রতিনিয়ত। শুরুতে অভাবই ছিল আমাদের সৃষ্টির সবচেয়ে বড় শক্তি।
বাচ্চু যখন ‘সোলস’-এ গিটারবাদক হিসেবে যোগ দেয় আমি তখন ঢাকায়। সে-ও তখন মাঝে-মধ্যে ঢাকায় আসত। ৮৬-৮৭ সালের দিকে একবারে ঢাকায় আসে। আমরা তখন একসঙ্গে থাকতাম, একই খাটে ঘুমাতাম। এক বাসায়ই তিন-চার বছর কেটে যায় দুই বন্ধুর। বাচ্চু তখন সারাক্ষণ গিটার প্র্যাকটিস করত। গিটারে যেভাবে সে দক্ষ হয়ে ওঠে তার সাক্ষী আমি। এমনও হয়েছে, দুজনের কোথাও দাওয়াত। আমি বলতাম, ‘কী রে, যাবি না?’ সে বলত, ‘গিটার বাজাচ্ছি।’ আমি দাওয়াতে গেলেও সে গিটার নিয়ে পড়ে থাকত। এমনও হয়েছে, দুজন দুজনের রুমে প্র্যাকটিসে এতটাই মগ্ন যে কারো সঙ্গে কারো কোনো কথা নেই। কিন্তু ঠিকই সন্ধ্যায় বের হতাম, আড্ডা দিতাম, রিকশায় ঘুরে বেড়াতাম, সিনেমা দেখতাম।
নতুন ব্যান্ড করার পর যখন তার আলাদা বাসা নেওয়ার দরকার হলো তখন আমার পাশের বাসাটাই ভাড়া নিল। তার জানালা ছিল ঠিক আমার জানালার পাশে। হাত দিয়ে হাত ধরা যেত। প্রতিদিন একজন আরেকজনকে ডেকে জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলতাম। এরপর বাচ্চুর প্রেম, বিয়ে। বিয়ের বাজার-সদাই থেকে শুরু করে পুরো কাজ বলতে গেলে আমিই করে দিয়েছি! মাঝে ব্যস্ততার কারণে আমাদের দেখা হতো কম। তবে আমি প্রায়ই বাসায় দাওয়াত দিতাম। সে আসতে পারত না। এ নিয়ে তার সঙ্গে অনেক অভিমানও করতাম।
বাচ্চু মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে শেষবার দেখা হয় আমাদের। তখন বলল, ‘দোস্ত, শেষ পর্যন্ত হয়ত আমাদের একজনকেই আরেকজনের কাঁধে নিতে হবে।’
বাচ্চু চলে যাওয়ার দিনটি আমার জন্য কতটা কষ্টের, কতটা ব্যথার ছিল বলে বোঝাতে পারব না। ওপারে চলে গেলেও প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে তার স্মৃতি-ভালোবাসা আমি অনুভব করি।
আজ তার জন্মদিন। এমন দিনে একটাই চাওয়া তার আত্মা যেন শান্তি পায়।
-শিশির