ফেসবুক থেকেঃ

প্রতিদিন সকালে মাছ কিনতে কিনতে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে । এইরকম এক মৎস্য ব্যবসায়ী সেদিন যা বললেন তা শুনে আমি স্তম্ভিত ! যা বললেন, তা যতটা সম্ভব অবিকৃতভাবে তুলে ধরার চেষ্ঠা করলাম ~
“বুঝলে দাদা, আমাদের এখানে সরকারী চাকরী-বাকরী একেবারে কমে গেছে, বাজারের অবস্থা খুব খারাপ । সামনে আমাদের খুব খারাপ দিন আসছে । বেশ কিছু কাস্টমার চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর আর আগের মত মাছ নেয় না । কিন্তু সে জায়গায় নতুন চাকরী পেয়ে যে কাস্টমার তৈরী হবে, তা একেবারেই হয় নি । সামনে আরও কয়েকজন চাকরীম্যান রিটায়্যার করবেন । তাই সামনে আরও কঠিন দিন আসছে ।”
“দাদা ভাবছো মাছ তো কেনেন সবাই । তাহলে সরকারী চাকরীর সঙ্গে এর সম্পর্কটা কি ? তাহলে শোনো দাদা, সত্যি কথাই বলি । তোমাদের মত খরিদ্দার আমাদের বাজারের আসল সম্পদ । শুধু মাছ নয়, সারা বাজার, এমনকি সব ধরনের মিস্ত্রী সবাই নির্ভর করে তোমাদের উপরই । তোমরা আছো বলেই সকাল সকাল মাছ বেচে এগারোটা-সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাড়ি চলে যেতে পারি । নইলে বেলা একটা-দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকতে হত । তোমরা বড়লোক (ধনী) নও, তবে তোমাদের পকেটে মাসকাবারী পয়সা থাকে । তোমাদের মত চাকরীম্যানরা সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটার আগে বাজারে আসে, অফিস যাওয়ার তাগিদে দরদাম বা যাচাই করে ঘুরে-ফিরে বাজার করার মত সময় সকাল বেলা তাদের হাতে খুব-একটা থাকেনা । পাইকারী ২৫০-৩০০ টাকা কেজির মাছ কিনে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিও তাদের বিক্রি করি সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত, ফলে প্রথমে ঘরের দান উঠে যায় সহজে । সব খরচ বাদ দিয়ে ৪০০-৫০০ টাকা লাভ হয়ে গেলেই আমি সন্তুষ্ট ।
“এরপর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকী মাছ ২০০ টাকা, ১৮০ টাকা এমনকি শেষে কেনা দামে ১৫০ টাকায় বিক্রি করতে পারি । শেষ বেলায় খালি করে বাড়ি যাওয়া নিয়ে কথা । তখন লাভ যা হওয়ার হয়ে গেছে চাকরীম্যানদের থেকে । যেসব লোক একটু পরে বাজারে আসেন, তাদের কম দামে মাছ বিক্রি করতে পারি শুধু তোমাদের মত কাকভোরের চাকরীম্যান কাস্টমার থাকার জন্যই । তোমাদের চাকরীর পয়সা কিন্তু শুধু আমরা খাই না । যারা আমাদের কাছে পরে ১৫০ টাকায় মাছ কেনে, তারাও তোমাদের পয়সা খায় । কারণ তোমাদের কাছে প্রথমে বেশি দাম পেয়ে যাই বলেই তো শেষ বেলায় কেনা দামেরও কম দামে মাছ বেচতে পারি ।”
দেখো না, আমাদের এখানে নতুন চাকরী-বাকরী পাওয়া তো বন্ধই হয়ে গেছে, সাধারণ মানুষ সবার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে এবং আরও যাবে । তোমাদের মতো চাকরীম্যানদের হাতে টাকা না থাকলে সামান্য মিস্ত্রীরাও কাজ পাবেনা ।
এবার আমি বললাম একজনকে চাকরী দিয়ে মাসে ত্রিশহাজার টাকা মাইনে না দিয়ে ঐ টাকায় তোমাদের মত ব্যবসায়ী বা মিস্ত্রীদের ৩৯ জনকে মাসিক একহাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হলে ক্ষতি কি ?
উত্তরে তিনি বললেন, “ঐ ভিক্ষার পয়সা চাই না । ওতে জল গরম হবে না । সমাজের শিক্ষিত মানুষের হাতে সরকার পয়সা তুলে দিলে সেই পয়সা ঘুরে-ফিরে আমাদের হাতেই চলে আসে । আমরা নিজেদের সামর্থ মত সেই পয়সাই অধিকার করে নিই । আমাদের কাছে সেটাই ভালো পথ । চাকরী বন্ধ হলে আমার ছেলেটাকে যে লেখাপড়া শেখাচ্ছি, সেও তো চাকরী পাবে না । আমার মতই তাকেও টেনশন-এ দিন কাটাতে হবে প্রতিদিন ।
শোনো দাদা, একটা ইঁটের বাড়ি তুমি তিন ইঞ্চি গাঁথনী দিয়েও করতে পারো । কিন্তু তাতে দশ ইঞ্চি পিলার দিতেই হবে । তুমি যদি ভাবো দশ ইঞ্চি পিলারে সিমেন্ট-স্টোন চিপস্ খরচ না করে পুরোটাই তিনইঞ্চি গেঁথে ঘরের সংখ্যা একটা বাড়াবো তাহলে পুরো বাড়িটাই ভেঙে পড়বে । তাই বাজার (হয়তো বলতে চাইছে সমাজ) ঠিক রাখতে গেলে শিক্ষিত মানুষকে তাদের প্রাপ্য দিতেই হবে । তারা পেলে আমরাও পাবো । তাদের হাত থেকে আমরা পেলে সেটা হবে আমাদের ‘অর্জন’ করা পয়সা, কিন্তু সেই পয়সা সরকারের হাত থেকে ভাতা হিসাবে পেলে সেটা হবে ‘ভিক্ষা’।”
ওর কথা শুনে আমার চোখ খুলে গেছে যে অর্থনীতি সমাজের দায়িত্ববান লোকেরা বোঝে না, তা ঐ মাছ ব্যবসায়ী বোঝেন।

FacebookTwitter

About Bangla Daily

একটি পরিপূর্ণ বাংলা অনলাইন পত্রিকা। মাতৃভাষার দেশ বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সস্প্রচারিত হচ্ছে।

View all posts by Bangla Daily