সুমি ইসলামঃ
বন্ধু মানে কী? বন্ধুর সংজ্ঞা কেমন? পরিচয় হলেই কি সে বন্ধুত্বের গন্ডিতে চলে আসতে পারে? বন্ধু নিয়ে আমরা কত কথা, কত স্টাটাস, কত কবিতা লিখে ফেলি সহজেই, কিন্তু বর্তমানে বন্ধুমানে কি সেটা আসলেই আমরা বুঝি? আমার মনে হয় আমরা বন্ধু শব্দটির মানে এখন আর তেমন বুঝিনা,হৃদয়ে ধারন করিনা। এখন মুখে মুখে বন্ধু বন্ধু করলেও হৃদয়ের গভিরে বন্ধুকে ধারন করিনা, করি না লালন।
বন্ধুত্ব মানে বিশ্বাস,বন্ধুত্ব মানে পরস্পরের মাঝে সহযোগিতা,বন্ধুত্ব মানে বিপদে পাশে থাকা, সুখে-দুঃখে এক থাকা। মোট কথা দুটি মানুষ একটি হৃদয়।
বন্ধু শব্দের মাঝে মিশে আছে নির্ভরতা আর বিশ্বাস। বন্ধু আর বন্ধন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বন্ধুত্ব মানেই যেন হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিংড়ে, ভালোবাসা দিয়ে মন খুলে জমানো কথা বলা,বন্ধু মানে রাত জেগে কথা বলা, বন্ধু মানে রাগ,বন্ধু মানে অভিমান, বন্ধু মানে নিরানন্দ জীবনে আনন্দের জোয়ার।
বন্ধুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জর্জ হার্ভার্ট বলেছেন, ‘একজন বন্ধু হলো সর্বোৎকৃষ্ট আয়না।’ তার মানে, এই আয়নাতে প্রতিমুহূর্তে সে নিজেকে দেখবে। শুধু বাহ্যিক অবয়বকে নয়, ভেতরটাকেও। বন্ধুত্বটা হওয়া চাই হাত আর চোখের সম্পর্কের মতো। হাতে ব্যথা লাগলে চোখে জল আসে। আর চোখে যদি জল ঝরে, তবে হাত এগিয়ে যায় তা মুছে দিতে।
বন্ধু’ শব্দটি অনেক ছোট , কিন্তু এর গভীরতা আর ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত। বন্ধুকে যেমন সংজ্ঞায়িত করা ঠিক না, তেমনি বন্ধুত্বেরও কোন সংজ্ঞা হওয়া উচিত না। বন্ধুত্বের কোন দিন নেই, বন্ধুকে ভালোবাসার মনে করার জন্য কোন নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন হয় না। প্রত্যেক দিন, প্রতিটা ক্ষনেই বন্ধুকে মনে হয়।
বন্ধুর কাছে যেতে কোন অনুমতির প্রয়োজন নেই,বন্ধুর জন্য মনের দরজা, ঘরের দরজা সবসময় উন্মুক্ত থাকে।বন্ধুর কাছে যেতে কোন নির্দিষ্ট কারনের দরকার হয় না।
ইংরেজি সাহিত্যের লেখক ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ পুরোহিতের কাছে যায়, কেউ কবিতার কাছে, আমি যাই বন্ধুর কাছে।’ বন্ধু সে তো সবার উর্দ্ধে, জীবনের কোনো নির্দিষ্ট বাঁকে নয়, কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে নয় বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি সারা জীবনব্যাপী। বন্ধুত্ব যদি নিখাদ হয় তবে জীবনের কোনো বাঁকেই তা শেষ হওয়ার নয়। সত্যিকার একজন বন্ধু যেমন সুখের সময় পাশে থাকে, ঠিক তেমনি দুঃখের দিনগুলোতেও লড়াইয়ের সাহস জোগায় পাশে থেকেই।’
বন্ধুত্ব শুধু এটাই নয় যে জন্মদিনে কেক কেটে বেলুন ফুলিয়ে আনন্দ করা, বন্ধু মানে এটা নয় যে হঠাৎ মনে হলেই মাঝ রাতে লং ড্রাইভে চলে যাওয়া।তারপর দীর্ঘ সময় আর কোন খোঁজ না থাকা।
বন্ধু হতে হলে মনে রাখতে হবে যাকে আমি বিশ্বাস করতে পারব, যার ওপর ভরসা করতে পারব, যাকে মনের কথা খুলে বলতে পারবো, যে সব ব্যাপারে পাশে থেকে সার্পোট দেবে, সুখের সময় যেমন পাশে থাকবে দুঃখের সময়ও দুরে সরে না গিয়ে একইভাবে পাশে থাকবে। তবেই সে প্রকৃত বন্ধু হবে।
বন্ধু নির্বাচনে খুব সবধানতা অবলম্বন করতে হবে নয়তো লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদির কল্যাণে এখন বন্ধু পাওয়াটা অনেক সহজ, এখানে আজ বন্ধুর ছড়াছড়ি। আজকাল এইসব সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এ্যাড হয়ে ২৪ ঘন্টা পার না হতেই আমরা একজন আরেকজনকে বন্ধু বন্ধু বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি।
বন্ধুর খোঁজ খবর নেওয়া, বন্ধুর সকল ব্যাক্তিগত তথ্য নেওয়া শুরু করে দেই,এটা আজকাল বড়ই হাসির ব্যাপার বলে মনে হয় আমার কাছে।
কাছ থেকে না দেখে শুধু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কথা বলে বা চ্যাটিং করে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের সম্পর্কে খুব বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। নয়তো ভুল মানুষটির বন্ধু হয়ে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’এখানে আমরা কাউকে না দেখে না জেনে না বুঝে বন্ধু বানিয়ে ফেলি এটা অনেক বড় ভুল কারন এই বন্ধুত্বটা ম্যাসেন্জারের মধ্যেই শুরু হয়, ঠুনকো কথা তে এখানে বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে। ব্লকের মধ্যেই শেষ হয় সব সম্পর্ক। এই বন্ধুত্বে থাকে না কোন বিম্বাস, থাকেনা আন্তরিকতা, থাকেনা ভালোবাসা।
মনে রাখতে হবে শুধু বন্ধু হলেই হবে না, বন্ধুত্বের সম্পর্ককে ধরে রাখার চেষ্টাও করতে হবে। বন্ধু ছাড়া জীবনে চলা অসম্ভব, জীবনে ভালো বন্ধু খুব জরুরি। তবে ভালো বন্ধু খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। সবাই ভালো বন্ধু চায় কিন্তু ভালো বন্ধু হতে পারে না। তাই বন্ধু নির্বাচনে একটু সচেতন হতে হয়। বন্ধুত্বকে কোনো পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে মাপা যায় না। মাপার দরকারও নেই।
তাই বন্ধু নির্বাচনের আগে কয়েকটি মানবিক গুণ তার মধ্যে খুঁজে নেয়া উচিত। তার মধ্যে সৎ ও সত্যবাদী গুণাবলি আছে কিনা বুঝে নিতে হয়। সে কতটা বিশ্বাসী, তার ভেতরে আন্তরিকতা কতটুকু, তার উপর কতটা ভরসা করা যায়,বন্ধুর মনের ভেতরটা আসলেই স্বচ্ছ না স্বার্থপরতায় কলুষিত তা বোঝার চেষ্টা করতে হয় তারপর তাকে ভালো বন্ধু বলে স্বীকৃতি দেওয়া ভালো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম, বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ।’