“বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু, তবু আজ কর্মহীন”

“বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু, তবু আজ কর্মহীন”
“বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু, তবু আজ কর্মহীন”

আমার ছাত্রলীগের রাজনীতি করার ইতিহাস

সালেক খান রিপন, শিক্ষানুরাগী ও গবেষকঃ

বাল্যকাল থেকে মেধাবী ছাত্র বলতে যা বোঝায় আমি তা-ই ছিলাম। নওগাঁ জেলার এক অখ্যাত প্রাইমারী স্কুল থেকে যখন কেউ বৃত্তি পায় নি আমি সেই স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেনিতে দ্বিতীয় গ্রেডে বৃত্তি পেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাপার নয়, আসলে নিজে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করাটাই আসল কাজ।

বৃত্তি পাবার পরপরই আমার বাবা মরহুম জয়নাল আবেদীন খান বাংলাদেশ রেলওয়ের টিটিই, যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে অনেক নির্যাতন ভোগ করেছিলেন এবং বিজয়ের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলা কারাগারে বন্দী ছিলেন, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে জীবিত মুক্তি পেয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন এবং বললেন আমাকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে হবে। বাবার স্বপ্ন পুরণের জন্য একটা মনছবি এঁকে ফেললাম ক্যাডেট হিসেবে এবং নিজে নিজে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।

ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলাম। বাবা স্বপ্ন দেখতেন আমি যেন সেনাকর্মকর্তা হই। কিন্তু তা আর হতে পারা গেল না। ক্যাডেট কলেজ থেকে সাফল্যের সাথে পাস করে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, সেখানে হলো না। অভিমানে বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবার সুযোগ পেলাম, হল বরাদ্দ পেলাম এস এম হল। ১৯৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে পত্রিকা মারফত জানতে পেরে ১২ অক্টোবর ঢাকার উদ্দেশে নওগাঁর তিন বন্ধু আমি, আলমগীর এবং ইউসুফ রওনা দিলাম। ১৩ অক্টোবর তিন বন্ধু একসাথে মধুর ক্যানটিনে প্রবেশ করলাম, উদ্দেশ্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে দেখা করা। পেয়ে গেলাম তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন মেহেদী ভাইকে।

তাঁর অভ্যর্থনা এবং আলিঙ্গনে প্রীত হলাম। শুরু হলো ছাত্রলীগের সংগে পথচলা। সেই সময় ছাত্রদলের সে কি দুর্দান্ত প্রতাপ, তারই মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পারিবারিকভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হলাম।

অনেক ছাত্র সংগঠন হলে সিট দেবার লোভ দেখিয়ে তাদের দলে টানতে চাইলো। কোনো দিকে কর্ণপাত না করে এস এম হলে যাতায়াত শুরু করে দিলাম, এই সময় কিছু দিন এক বন্ধুর মেসে থাকতাম। এস এম হলে পেয়ে গেলাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক আতাউর রহমান আতা ভাইকে, তাঁকে বললাম, থাকবো কোথায়? তিনি বললে, আমার রুমে থাকবে, নিজে মেঝেতে ঘুমিয়ে আমাকে তাঁর বেডে ঘুমাতে দিতেন।

আমাদের ভর্তির পর হলে মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ দেয়া শুরু হলো। আমি একটা সিট বরাদ্দ পেয়ে গেলাম। এরই মধ্যে জাতির পিতার নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল চালু হয়ে গেল এবং সেখানে থাকতে ইচ্ছুক বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহবান করা হলো। বঙ্গবন্ধুর নামে হল! সেই হলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হবার সৌভাগ্য হাত ছাড়া না করতে রীতিমতো দরখাস্ত নিয়ে এস এম হলের প্রভোস্ট স্যার প্রফেসর মহসীনের অফিসে চলে গেলাম তাঁর অনাপত্তি নিতে। তিনি বললেন প্রথম বর্ষেই সিট পেয়েছো হল চেঞ্জ করার দরকার কি? তার উপর এই হলে বঙ্গবন্ধু থাকতেন। আমি বললাম, স্যার ঐ হলটার নাম তো বঙ্গবন্ধু হল, আমি ঐ হলের প্রথম ব্যাচের আবাসিক ছাত্র হতে চাই। তারপর স্যার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে অনুমতি দিলেন।

উল্লেখ্য এস এম হলে থাকাকালীন এস এম হল শাখার ছাত্রলীগের একটা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। শাহ আলম ভাই সভাপতি, আমাকে হলে আশ্রয়দাতা আতাভাই হলেন সাধারণ সম্পাদক, আমার ক্লাসমেট ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোয়াজ্জেম সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আমি পেলাম প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব।

যতদিন এস এম হলে ছিলাম ছাত্রলীগের সংকটময় মুহূর্তে দলকে শক্তিশালী করতে যত পরিশ্রম করতে হয়েছিল তা করেছিলামও এবং তাতে এস এম হলে ছাত্রলীগের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছিল।

পরে বদলি হয়ে এলাম প্রাণের নেতার নামকরণে বঙ্গবন্ধু হলে। ১৯৮৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ছাত্রদল, ছাত্র শিবির (যদিও তাদের প্রকাশ্য অস্তিত্ব ছিল না ) বাদে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বাকি সব ছাত্র সংগঠন একত্রিত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো।

বঙ্গবন্ধু হল সংসদে নির্বাচন করার জন্য ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ভাই আমাদের নওগাঁর তিন বন্ধু আলমগীর, ইউসুফ এবং আমাকে ডেকে বললেন, তোমাদের মধ্যে থেকে একজনকে মনোনয়ন দেয়া হবে, কে নিবা? সদ্য ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে এসে ছাত্র রাজনীতির হালচাল বুঝে উঠতে না পেরে আমি আলমগীরের নাম প্রস্তাব করলাম, ইউসুফও সম্মতি দিল।

ডাকসু নির্বাচন হলো, সুলতান-মোস্তাক-নাসির পরিষদ জয় লাভ করলো। একমাত্র জিয়া হল ব্যতীত সকল হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জয় হলো। আমার বন্ধু বঙ্গবন্ধু হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হলো।

নির্বাচনের ফলাফল ছাত্রদল মেনে নিতে না পেরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিজয় মিছিলে হামলা করে ছাত্রীদের লাঞ্চিত করলো, গোলাগুলিতে একজন ছাত্র নিহত হলো।

ছাত্রদলের হিংস্র চেহারা দেখে আমরা আর হলে যেতে পারলাম না, কেননা বঙ্গবন্ধু হলের চারিপাশে জিয়া হল, জসীমুদ্দিন হল, সূর্যসেন হল আর মহসিন হল ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণে। বেশ কিছুদিন ছাত্রলীগের ঘাঁটি বলে পরিচিত সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, এস এম হল এবং জগন্নাথ হলের বিভিন্ন রুমে রাত কাটাতে লাগলাম। পড়াশোনার বারোটা বেজে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হলে বঙ্গবন্ধু হলে ফিরে গিয়ে রুমে উঠলাম। কিন্তু ছাত্রদলের রক্তচক্ষুর ভয়ে হলে মিছিল মিটিং করতে না পারলেও ক্যাম্পাসের মিছিলে নিয়মিত শামিল হতাম।

দেখতে দেখতে ডাকসুর মেয়াদ শেষ হওয়ায় ১৯৯০ সালে আবার ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ না থাকায় সকল ছাত্র সংগঠন এককভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিল। এবার আর প্রার্থী হবার সুযোগ হাতছাড়া না করে ভিপি, জি এস, এ জি এস নয়, হল সংসদে ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচন করলাম। পরাজিত হলাম সারা ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের একক আধিপত্যের কারণে। নির্বাচনে প্রার্থী হবার অপরাধে হল ছাড়া হলাম। বন্ধু শাহিনের কাজীপাড়ার বাসায় থেকে ক্লাস এবং পরীক্ষা দিতে লাগলাম। পরিবেশ শান্ত হবার পরে আবার নিজের রুমে গিয়ে উঠলাম ঠিকই, কিন্তু দুদিন রুমে থাকতে পারলে পাঁচদিন গিয়ে জহুরুল হক হলে থাকতে হতো।

হলে থেকে না থেকে মাস্টার্স পাস করে বি সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডার এ চাকরি পেলাম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন সে বছরই ১৩ আগস্ট তারিখে প্রভাষক হিসাবে খুলনা বি এল কলেজে যোগদান করলাম।

বি এল কলেজে তখন ছাত্রলীগের অবস্থান শক্তিশালী ছিল না। গোপনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক দীক্ষা দিতে শুরু করলাম। সুদীর্ঘ এক যুগের বেশি বি এল কলেজে চাকরি করে সারা খুলনায় একদল ছাত্রলীগের ভক্ত অনুরাগী রেখে এসেছি, এরপর পদন্নোতি পেয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজে যোগদান করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি করার পরামর্শ দিয়ে দুবছর চাকরি করে, আওয়ামীলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বর্তমানে আওয়ামীলীগের উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বন্ধু আমিনুল ইসলাম আমিনের সহায়তায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করাকালীন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনায় নিরলস কাজ করে গেছি ২০১৯ সালের ১০ জুন পর্যন্ত।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার এখন ক্ষমতায় আর আমি বর্তমানে দায়িত্ব-কর্তব্যহীন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মহীন জীবন যাপন করছি। সময় কাটছে বঙ্গবন্ধুর লেখা ” অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়া চীন পড়ে।

-শিশির

FacebookTwitter