সুমি ইসলাম:
সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীর প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়, পাল্টে যায় মানুষ, পাল্টে যায় মানুষের আচরণ, পাল্টে যায় সমাজ ব্যবস্থা, পাল্টে যায় ফ্যাশন-আইকন।
সুখময় স্মৃতি ক্রমে ক্রমে সরে যায় দুরে ,খারাপ সময়ের পরিমাণ বেড়ে যায়, সামনের পথটা অস্পষ্ট; বড্ড অচেনা লাগে, বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় নিশ্চিন্ত দূরন্ত শৈশবে, ফিরে যেতে মন চায় ভাটিয়ালি গানে, গিয়ে বসতে ইচ্ছে করে আবলুশি রোদের উঠানে।
নদীর বুকে বয়ে চলা ছিপ, পানসি, কোষা, ঘাসি, সাম্পান, বজরা, ময়ূরপঙ্খী নৌকার ভীড়ে। খুঁজে ফিরি গুন টানা মাঝি-মাল্লাদের , নৌকার নিশানা পেতে টেনে যায় নাও, ঝড় আসে, বৃষ্টি আসে, মেঘ গর্জায় জোরেশোরে, তবুও গাঙের কিনারে থামে না তার পাও।’
কোথায় হারিয়ে গেলো গুনটানা মাঝি, তিরিশ চল্লিশ বছর আগেও গাঙের কিনার দিয়ে হেঁটে যেত গুনটানা মাঝিমাল্লারা, এখন শুধুই স্মৃতি।
শরতের বিকেলে আকাশ জুড়ে বয়স্ক , যুবক, কিশোর, শিশুদের রঙবেরঙের ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতায়, সন্ধ্যে হলে বটগাছের তলায় মুরব্বীদের আড্ডায়, ঘরে ঘরে কুপি জ্বালিয়ে পাঠ্য বই এর ছড়া কবিতা সুর করে পড়তে বসায়।
হেমন্তের রোদমাখা শীতে গ্রাম বাংলার বিল-ঝিলের পানি কমে গেলে মানুষ দলে দলে পলো নিয়ে মাছ ধরতে বিলে নামতো, তলাবিহীন কলসির মতো দেখতে, বাঁশ-বেতের তৈরি শৈল্পিক কারুকার্যময় যে জিনিসটি দিয়ে মাছ ধরা হয় আঞ্চলিক ভাষায় তার নাম ছিলো পলো, কোথায় গেলো সেই পলো উৎসব! মন চলে যায় পলো উৎসবের পুকুর , খালের মাঝে।
খুঁজে ফিরি সেই বাড়ি; বাড়িতে কাঠের ঢেঁকির ঢাকুস ঢুকুস শব্দ, আমন ধান কাটা শেষে পৌষ মাসে ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গার শব্দে অনেকের রাতের ঘুম নষ্ট হতো। আবার ভোর বেলা ঢেঁকির শব্দে অনেকের ঘুম ভাঙত। ধান ভেঙ্গে চাল ছাঁটার জন্য মহিলাদের পাশাপাশি আবার কখনও কখনও পুরুষরাও ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভাঙতো। দু’জন মহিলা সারাক্ষণ ঢেঁকিতে পাড় দিত আর একজন ধানগুলোকে উনুতে (ভাঙ্গার গর্তে) এগিয়ে দিত।
ঢেঁকি ছাটা চালের ভাতে বেগুন ভর্তা, মূলা-পালং শাকের সাথে টেংরা মাছ আর কুমড়ো বড়ির তরকারি।
সপ্তাহের শনি-মঙ্গল হাটবার, বটগাছের তলায় বা নদীর তীরের হাট শেষে ঝুড়ি ভর্তি আনাজ আর জ্যান্ত মাছ হাতে ঝুলিয়ে বাবার বাড়ি ফেরায়, লাকড়ির চুলায় মাটির হাড়িতে মায়ের রান্নায়।;
মাস ধরে চৈত্র সংক্রান্তীর মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা, কাঁচের চুড়ি, রঙ্গীন ফিতা, মাটির পুতুল, খই, মুরকি, চিনির ছাচে তৈরী হাতি-ঘোড়া বিভিন্ন রকম ফল-ফলাদি ও মিষ্টি , সার্কাস, পুতুলনাচে, আর সেই অসাধারন দৃশ্য; রং-বেরঙের কাপড় পরে হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচিত ধারা বর্ণনা- ‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’- এ সুর আর ছন্দের তালে তালে ধারা বিবরণী বায়োস্কোপওয়ালার চারপাশে ছোট ছোট বাচ্চাদের ভীড়ের মাঝে।
সেই শৈশব , সেই কৈশোর ফেলে মানুষ চলে যায় দুরে বহুদূর, পিছনে পরে রয় ফেলে আসা রাস্তা, চলে যাওয়া সময়, পরিচিত মুখ, চেনা পরিবেশ, শিউলি আর হাসনাহেনার গন্ধ, তপ্ত দুপুরে শীতল পুকুরে হাঁসেদের সাতার, পানির ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া মাছেদের আনন্দ, নতুন ফষল পেয়ে কৃষাণীর মুখের মধুর হাসি, কুয়াশা মাখা ভোরে গরম গরম ভাপা পিঠা, তপ্ত দুপুরে গাছের ছায়াই বসে কাঁচা মরিচ, পেয়াজ মেখে ভাত খেয়ে কৃষকের তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠা, শীতের সকালে খড়কুটো জরো করে আগুন লাগিয়ে তার চারপাশে একসাথে বসে বৃদ্ধ যুবক শিশুদের আগুন পোহানো, বাতাসের সাথে ভেসে আসা সফেদার গন্ধ! মাঝ রাতে ডাহুকের একটানা ডেকে চলা, এখন যেনো সবই অচেনা; বদলে গেছে সবকিছু।
তারপর একদিন ক্লান্ত দেহে বাশেঁর মাচার উপর বসে চারদিকে তাকিয়ে দেখি কিছুই তো বদলায়নি, সব কিছুই রয়ে গেছে আগেরই মতন, আকাশটা যেখানেই আছে, ছিল সেখানেই, রাতের আঁধারের বুকে জ্বল জ্বল করছে লক্ষ তারা,সন্ধ্যা হলে হিমেল বাতাসের সাথে ভেসে আসে কামিনী আর হাসনাহেনার ঝাঁঝালো গন্ধ, দক্ষিণা বাতাসে আজো দোল খেয়ে যায় মাঠের মাঝে কিশোরী সবুজ ধান গাছ।
সবশেষে তাকিয়ে দেখি দূরে চলে যাওয়া আঁকা বাঁকা রাস্তাটার দিকে, রাস্তাটা যেমন ছিলো তেমনই আছে এতটুকুও বদলায়নি।
আসলে বদলে গেছে সেই পথের উপর পা রেখে হেঁটে আসা মানুষ নামের পথিকগুলো। প্রতিটি নতুন দিনের আগমণে, চলমান দিনটি এক সময় লেখা হয় অতীতের খাতায়। আর সেই দিনটির সাথে জড়িয়ে থাকা সুখ দুঃখের দৃশ্য ও ঘটনাবলী যোগ হয় স্মৃতির পাতায়।;
আর একদিন সে পাতাটাও ঝরে যাবে। পথ ও পরিক্রমাগুলো অমলীন ও আবহে থেকে যাবে ঝরা পাতার অনুপস্থিতিতে।
-শিশির