সারাদেশঃ
নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরো অন্তত ১৫ জন জড়িত ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত অন্যতম দুই আসামি নুরউদ্দিন ও শাহদাত হোসেন শামীম গত রোববার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এজাহারে বর্ণিত ঘটনা স্বীকার করে।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘটনায় জড়িত আরো অন্তত ১৫ জনের নাম উল্লেখ করেছে এই দুই আসামি। এর মধ্যে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনও ঘটনা জড়িত বলে আদালতকে জানায় নুরউদ্দিন ও শামীম।
দুই আসামির এমন জবানবন্দির পর রোববার রাতেই রুহুল আমিন গা ঢাকা দেন বলে স্থানীয় কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে। তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চেয়ে মুঠোফোন নম্বরে কল করলেও অপর প্রান্ত থেকে কল রিসিভ করেনি কেউ।
তবে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা কারাগার থেকেই নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেন। আর ঘটনার এক দিন আগে ৪ঠা এপ্রিল বিকালে ফেনীর জেলা কারাগারে দেখা করে নির্দেশনা বুঝে নেয় নুরউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন।
নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয়া পাঁচজনের পরিচয়ও মিলেছে জবানবন্দিতে। এদের মধ্যে ছিল দুইজন নারী ও তিনজন পুরুষ। পাঁচজনের সবাই সোনাগাজী মাদরাসার শিক্ষার্থী।
এজাহারে উল্লেখ করা ১৩ জনের বাইরে ঘটনায় জড়িত বেশিরভাগই সোনাগাজীর ওই মাদ্রাসার আলিম ও ফাজিল শ্রেণির শিক্ষার্থী। এছাড়া মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষকও এমন নির্মম ঘটনায় মদত দিয়েছে বলেও আদালত ও তদন্ত সূত্রে জানা গেছে।
অধিকতর তদন্তে এদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাদের নাম অর্ন্তভূক্ত করা হবে বলে মামলার তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে জানা গেছে।
গত রোববার বিকাল ৩টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা ধরে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
জবানবন্দিতে নুরউদ্দিন ও শামীম পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। এর আগে ঢাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদর দপ্তরে এজাহারভুক্ত আসামিসহ মোট ১৩ জন হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত বলে জানান পুলিশের এই ইউনিটের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।
পিবিআইয়ের ফেনীর দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান রবিবার মধ্যরাতে সাংবাদিকদের জানান, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নুরউদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম অনেক তথ্য দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাহর নির্দেশে তারা কীভাবে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কীভাবে কী করে তা বিস্তারিত বলেছে।
পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, নুরউদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম আরও কিছু নাম বলেছে।
আমরা তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করছি না। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে বাকিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। তদন্ত সূত্র জানায়, ২৭শে মার্চ নুসরাতকে যৌন হয়রানির পর থানা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্বও নিয়েছিলেন রুহুল আমিন।
যৌন হয়রানির মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নির্দেশে নুরউদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম অধ্যক্ষের মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করে।
এজন্য সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মুকছুদ আলম তাদের ১০ হাজার টাকাও দিয়েছিল। এছাড়া মাদরাসার আরেক শিক্ষকও আন্দোলন ও নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেন। ঘটনায় জড়িত শিক্ষকদের মধ্যে আফসার উদ্দিনের নামও বলেছে প্রধান দুই আসামি। সরাসরি কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেয়া শাহাদাত হোসেন শামীম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর সে দৌঁড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের নিচু প্রাচীর টপকে পার হয়ে যায়। ঘটনার পর দুই মিনিটের মধ্যে নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে কল করে বিষয়টি জানায় শামীম। উত্তরে রুহুল আমিন বলেন, আমি জানি।
তোমরা চলে যাও। নুসরাতের শরীরে আগুন দিয়ে ভবন থেকে নেমে প্রথমেই শামীমের সাথে কথোপকথন হয় রুহুল আমিনের। কয়েক সেকেন্ডের ওই আলাপে ঘটনায় রুহুল আমিনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের এই নেতার বিষয়ে শাহাদাত হোসেন শামীম বলেছে, নুসরাতের দায়ের করা মামলার পর রুহুল আমিন থানা ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এদিকে, প্রায় দেড় মাস আগে প্রেমের প্রস্তাব দিলে শামীমকে ফিরিয়ে দেয় নুসরাত। সে সময় শামীমকে অপমানও করা হয় বলে জবানবন্দিতে বলেছে সে। নুসরাতের প্রতি নিজের ক্ষোভ থাকার কথা উল্লেখ করে শাহাদাত হোসেন শামীম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, সে নিজেও নুসরাতের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। এসব কারণে অধ্যক্ষ সিরাজের নির্দেশে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। নুসরাত কিলিং মিশনে শামীম নেতৃত্ব দিলেও এতে অংশ নেয় আরো চারজন।
এদের প্রত্যেকেই সোনাগাজী মাদরাসার শিক্ষার্থী। শামীম ছাড়া বাকি চার জন হলো: অধ্যক্ষের ভাগ্নী উম্মে সুলতানা পপি, নুসরাতের সহপাঠী কামরুন্নাহার মনি, আলিম প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জাবেদ এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও শামীম-নুরউদ্দিনের বন্ধু জোবায়ের। এদের মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি ও কামরুন্নাহার মনি নুসরাতের সহপাঠী। তারা দুজনেই সেদিন বোরকা, হাতমোজা ও দড়ি ম্যানেজ করে। আর উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে ডেকে নিয়ে যায় ছাদে। পপি ও মনি মিলে শম্পা নামের ফাঁদ ফেলে। মূলত নুসরাত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য নিজে থেকে নুসরাতের সামনে বার বার শম্পা নামটি বলার চেষ্টা করে পপি ও মনি। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া প্রত্যেকে বিভিন্ন পরীক্ষায় অধ্যক্ষের কাছ থেকে আগেভাগে প্রশ্ন পেতো বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে শামীম।
এছাড়া, নানা সময় অনৈতিক সুবিধাও দিতেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। আরেক আসামি নুূরউদ্দিন জানিয়েছে, তার সঙ্গে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ভালো সম্পর্ক ছিল। এ কারণে তার নির্দেশে তারা পরিকল্পনা করে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ঘটনার সময় সে ভবনের নিচে ছিল। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপি গিয়ে নুসরাতকে ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায়। ওই সময় ছাদে কামরুন্নাহার মনি বোরকা পড়ে অপেক্ষায় ছিল। নুরউদ্দিন জানিয়েছে, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নানা সময়ে ছাত্রীদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের যৌন হয়রানি করতো। ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে গত ২৭শে মার্চ যৌন হয়রানি করেছিল ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। এ ঘটনায় নুসরাত থানায় অভিযোগ করলে অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এরপর থেকেই মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা তুলে না নেয়ায় নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। গত ৬ই এপ্রিল পরীক্ষার আগ মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলে নুসরাতকে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়। শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় জীবনের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান নুসরাত। গত ১০ই এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরদিন সোনাগাজীর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় নুসরাতকে। এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠে সারাদেশে। জড়িতদের গ্রেপ্তারে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন।