নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা, আসলে কিভাবে ঘটনা ঘটলো

আন্তর্জাতিকঃ

স্থানীয় সময় শুক্রবার। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে সপ্তাহের পবিত্র দিন। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে সবাই জুমার নামাজ পড়ছিলেন। এরই মধ্যে মুহুর্মূহু গুলি। অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। প্রাণভয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি। বাঁচার জন্য অনেকে মেঝেতে শুয়ে পড়েও সন্ত্রাসী এবং কট্টর ডানপন্থি বন্দুকধারীর হাত থেকে রক্ষা পাননি।

প্রায় একই সময়ে দু’টি মসজিদে চালানো ভয়াবহ হামলায় অন্তত ৪৯ জন নিহত ও ৪৮ জন আহত হয়েছেন যাদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি। রক্তে ভেসে যায় পুরো মসজিদ। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা।

হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে মূল হামলাকারীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দুই বছর ধরে হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের সরকার এবং রাষ্ট্র প্রধানরা নৃশংস হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন।

তিন বাংলাদেশি নিহত বন্দুকধারীর হামলায় অন্তত তিন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বলে সেখানে বাংলাদেশ হাই কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারী কনসাল জেনারেল শফিকুর রহমান বলেন, দুই বাংলাদেশির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। একজন ড. আবদুস সামাদ যিনি আল নূর জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করতেন। এক সময় তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। অন্যজন হোসনে আরা পারভীন। তিনি গৃহবধূ। অসুস্থ স্বামী ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে মসজিদে গিয়েছিলেন। নিহত তৃতীয় ব্যক্তির বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। আহত অন্তত ৫ বাংলাদেশির মধ্যে দু’জনের অবস্থা গুরুতর বলে জানান শফিকুর রহমান।

হামলায় ভারতের ২ এবং ইন্দোনেশিয়ার ৬ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিউজিল্যান্ডের ভারতীয় হাই কমিশন জানিয়েছে, অন্তত দুইজন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ৯ জন। আহতদের মধ্যে আছেন ভারতের শীর্ষ মুসলিম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াসি। তার অবস্থা গুরুতর। ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা সঞ্জীব কোহলি জানান, ক্রাইস্টচার্চ শহরে অন্তত ৩০ হাজার ভারতীয় পাসপোর্টধারী এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি রয়েছেন।

নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চের দু’টি মসজিদে গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৪৯ জন নিহত এবং ৪৮ জন আহত হয়েছেন। কোন মিডিয়া বলছে, সেজদার সময়ই হামলার ঘটনা ঘটে। আবার কোনটি বলছে, নামাজের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই হামলা হয়। ৪১ জন আল নূর মসজিদে এবং ৭ জন মারা গেছেন লিনউড মসজিদের হামলায়। আরেকজন হাসপাতালে চিকিত্সা নেওয়ার সময় মারা যান।

সন্ত্রাসী হামলা হয় দুই মসজিদে

হামলাকারী প্রথমে পুরুষ এবং পরে নারীদের কক্ষে হামলা চালায়। ২৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তাকে আজ শনিবার আদালতে হাজির করা হবে। পুলিশ মোট চারজনকে আটক করেছে। এদের মধ্যে একজন নারীও আছে। তবে আটক একজন ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলে পুলিশ জানায়। দুই বছর ধরে এই হামলার পরিকল্পনা চলছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন একে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি এটিকে দেশটির ইতিহাসের ‘কালো দিনগুলোর’ একটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, নিউজিল্যান্ড শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটির সামপ্রতিক ইতিহাসে এই ধরনের সন্ত্রাসী হামলা এই প্রথম বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আল নূর মসজিদে প্রথম হামলার কিছুক্ষণ পর লিনউড মসজিদে হামলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হেলমেট পরিহিত বন্দুকধারী মসজিদের ভেতরে প্রার্থনারত প্রায় ১০০ জনের দিকে গুলি চালানো শুরু করে। তার পরনে সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল।

সাইয়েদ আহমেদ নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী নিউজিল্যান্ডের মিডিয়াকে জানান, বন্দুকধারী গুলি চালানোর সময় চিত্কার করে কিছু একটা বলছিল। সাইয়েদ বলেন, তিনি অন্তত আটজনকে মারা যেতে দেখেছেন, যাদের মধ্যে দু’জন তার বন্ধু। ক্রাইস্টচার্চের সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ। শহরতলীর লিনউড এলাকার আরো একটি মসজিদ থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে হাজার খানেক শিশুর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ডুনেডিনে অভিযান চালিয়েছে। হামলাকারীর গাড়িতে এই ঠিকানা দেওয়া ছিল।

ফেসবুক লাইভঃ মোহন ইব্রাহীম নামের প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, টানা ১৫-২০ মিনিট গুলি চালায় বন্দুকধারী। ইব্রাহীম গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর জানালা দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। গুলি চালানোর ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার করে হামলাকারী। গুলি চালানোর সময় তার মাথায় লাগানো ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করা হয়। পুলিশ মানুষকে অনুরোধ করেছে যেন তারা এই ‘অত্যন্ত পীড়াদায়ক’ ভিডিওটি শেয়ার না করে।

ফেসবুক জানিয়েছে, তারা বন্দুকধারীর ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট সরিয়ে নিয়েছে এবং ভিডিওটিও পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

প্রাণে বেঁচে গেছেন ক্রিকেটাররা

নিউজিল্যান্ড সফররত বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ঐ সময় মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তামিম ও মুশফিকরা হামলার সময় মসজিদের ভেতর প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন, তখন তাদেরকে সতর্ক করা হয় এবং তারা পাশের একটি পার্কে ঢুকে পড়েন। ক্রিকেটাররা সবাই সুস্থ আছেন।

বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নিন্দা ও শোক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হামলার ঘটনায় শোক প্রকাশ করে টুইট করেছেন। নিন্দা জানিয়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, অর্থহীন সহিংসতায় প্রাণহানি এবং মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় তিনি গভীরভাবে শোকাহত। নিউজিল্যান্ডের সব নাগরিক, বিশেষ করে মুসলিম সমপ্রদায়ের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন পোপ।

ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, ফিলিপাইন ও তুরস্কের সরকার প্রধানরা নিন্দা জানিয়েছেন। নিউ ইয়র্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট শুক্রবার শহরের মসজিদগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ফ্রান্সের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

FacebookTwitter