এমএস ইসলাম মৃধা, ব্যবসায়ীঃ
দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বছর দু’য়েক আগে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের আন্দোলন, নির্বাচন ও গণতন্ত্র’ সম্পর্কে একটি চমৎকার বক্তব্য দেন। জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক গুণীজন বক্তৃতামালার চতুর্থ বক্তৃতা ছিল এটি।
২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে (১৮ জানুয়ারি ২০১৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই একক বক্তৃতায় রওনক জাহান নিরাসক্তভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গতি-প্রকৃতি, বিষয়-বৈশিষ্ট্য ও প্রবৃত্তি-প্রবণতা তুলে ধরেন। যদিও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের ‘রাজনৈতিক দল চিন্তাকেন্দ্রিক’ ছিল বক্তব্যটি- এটি পরিব্যাপ্ত হয় বর্তমান অবধি। সাধারণভাবে সব রাজনৈতিক দলের মূল সমস্যা হিসেবে আটটি বিষয় নির্ধারণ করেন রওনক জাহান।
এগুলো হলো- ১. সাংগঠনিক দুর্বলতা; ২. অভ্যন্তরীণ কোন্দল; ৩. সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রী নির্ভরতা; ৪. উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব; ৫. রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন; ৬. ক্রমবর্ধমান অর্থের আধিক্য; ৭. রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও ৮. ক্রমহ্রাসমান আদর্শ।
কোনো একটি দলের রাজনৈতিক বিষয় নয় এগুলো। এসব বৈশিষ্ট্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমভাবে প্রযোজ্য না হলেও কমবেশি এসব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে সব রাজনৈতিক দলে। তবে এটাও সত্য যে, ক্ষমতায় থাকলে এক ফল আর না থাকলে আরেক ফল। ক্ষমতার দাপট দিয়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা বা অভ্যন্তরীণ কোন্দল ঢেকে রাখা যায়। আর আজকাল তো রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে বিভাজন রেখা একরকম উঠেই গেছে। এখন আর ভিন্নতরভাবে ওসি বা ডিসির কর্তৃত্ব অনুভূত হয় না। এমন কিছু বিষয়-আশয় আছে যা ক্ষমতার আবহে পরিবর্ধিত-পরিমার্জিত হয়। দল ক্ষমতায় থাকলে প্রকট হয়ে ওঠে নেতা-নেত্রী নির্ভরতা।
প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ। রওনক জাহান রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠনের সাধারণ অভিযোগ করেছেন। ইতঃপূর্বে এই অভিযোগ উত্থাপিত হতো ক্ষমতাসীন থেকে যারা দল গঠন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে। তাৎপর্যের বিষয়, এখন যারা জনগণ থেকে দল গঠনের দাবি করছেন তাদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। এখন সরকারের নীতিকৌশল নির্ধারণ, শান্তি ও শাস্তি, গুম ও খুন সবকিছুর জন্যই এজেন্সির দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করেন পর্যবেক্ষকরা। এটি দুর্ভাগ্যের বিষয়। এমন দুর্ভাগ্য এবং সৌভাগ্যের মধ্য দিয়েই অতিক্রান্ত হয়েছে এই জাতির ৫০ বছর।
১৯৯১ সালের পর রওনক জাহান কথিত সব ভালো-মন্দ নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ ট্রায়াল অ্যান্ড এরর-এর মধ্য দিয়ে বাই পার্টি সিস্টেম বা দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করতে চাচ্ছিল। পাঁচ বছর পরপর যদি এভাবে ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্য হতো, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত প্রধান দু’টো দল তা মেনে নিত তাহলে বাংলাদেশ হতে পারত তৃতীয় বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের উৎকৃষ্ট নমুনা। কিন্তু দু’দলই ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের প্রবণতা দেখিয়েছে।
২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি যদি ব্যক্তিনির্ভরতার বদলে নীতিনির্ভরতা দেখাতে পারত তাহলে তাদের জন্য এই ভাগ্যবিপর্যয় হয়তো ঘটত না। এরপর প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে যেভাবে সামরিক হস্তক্ষেপ অনিবার্য করে তুলেছিল তা গণতন্ত্র এমনকি দেশপ্রেমের কাছেও একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে এখন সত্য উন্মোচিত হচ্ছে। ‘প্যাকেজ ডিল’, ‘ইন্দো-মার্কিন আঁতাত’ এবং ‘অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র’ ইত্যাদি শব্দমালা উচ্চারিত হচ্ছে কোথাও কোথাও।
দ্বি-দলীয় সরকার ব্যবস্থার উজ্জ্বল সম্ভাবনায় সর্বশেষ কুড়াল মারে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ছলে-বলে-কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দেয়। দৃশ্যমান বাস্তবতা প্রমাণ করে, সরকার নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়। যেখানে তারা ১৫১টি নির্বাচনী এলাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত দেখায় এবং অন্যত্র নামকাওয়াস্তে নির্বাচন করে। সেখানে নির্বাচনটি ব্যর্থ হয়েছে সেটা দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়। কিন্তু সরকার ক্ষমতায় থাকলে যে কাগুজে নির্বাচন করতে পারে সে অভিজ্ঞতা বিএনপির ছিল। বিএনপি নেতৃত্ব তা বুঝতে ব্যর্থ হয়। এ সময়ে আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব জাতিকে আশ্বস্ত করে যে, এটি সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। অতি শিগগিরই আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিদেশী বন্ধুরাও অনুরূপভাবে আশ্বস্ত করে।
খলের আশ্বাসবাক্যে বিশ্বাস স্থাপন ছিল একটি নিশ্চিত প্রতারণা। নীতিবিদ রাজনীতিবিদরা শঠতা ও কপটতার আশ্রয় গ্রহণ না করলেও বুদ্ধিমান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে কোনো বাধা নেই। ২০০৬ সালের ভাগ্যবিপর্যয় থেকে শুরু করে সবই যে ব্যর্থতার ইতিহাস এ কথা বললে অসত্য বলা হবে। আন্দোলন, সংগ্রাম ও নির্বাচন- এতে যেটুকু অর্জন সবটুকু কৃতিত্ব শীর্ষ নেতৃত্বের। এত নির্মম অন্যায়-অত্যাচার, জেল-জুলুম, লোভ ও ভীতি উপেক্ষা করে বিএনপি যে তার স্বকীয় আদর্শে এখনো টিকে আছে তার কৃতিত্ব ‘কালেকটিভ লিডারশিপে। অমত-দ্বিমত অবশ্যই ছিল এবং আছে। এর মাঝে প্রিয় সত্য এই, শীর্ষ নেতৃত্ব দৃশ্যমানভাবে এক ও অভিন্ন থেকেছে।
২০২০ সালের প্রান্তিক সময়ে মহামারীর প্রকোপে রাজনীতিও যখন মহামারী আক্রান্ত তখন এর বিপরীতে জনগণ প্রত্যাশার স্বপ্ন দেখে। আশায় বুক বাঁধে মানুষ। বিএনপি যেমন একটি আশঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করছে তেমনি তাদের ঘিরে আশা-আকাঙ্ক্ষারও শেষ নেই। হতাশাবাদীরা বলছেন, বিএনপি শেষ হয়ে গেছে। আর ঘুরে দাঁড়ানোর সময় পাবে না। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, বিএনপি যে একইভাবে সরকারের চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে তার প্রমাণ নিত্যদিন নেতা-নেত্রীদের গালাগালি ও আহাজারি। বিএনপির জন্য তারা বিগলিত ব্যানার্জি। ওবায়দুল কাদের পাখির ডানা কেটে তাদের উড়তে বলছেন। হাত-পা বেঁধে দিয়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় আহ্বান করছেন। সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ! আশাবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যুক্তি তুলে ধরছেন : একটি রাজনৈতিক দলের ভিত্তি যদি হয় জনগণ তাহলে বিএনপি এখনো এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নীরব জনগোষ্ঠী বিএনপির সাথে আছে। বিগত সঠিক নির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যান নিলে দেখা যায়, জনগণের কমবেশি ৩৫ শতাংশ বিএনপিকে সমর্থন করে। প্রায় একই পরিমাণ লোক আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। কমবেশি ১০ শতাংশ ইসলামপন্থীদের ভোট। বাকি দোদোল্যমান ২০ শতাংশ বিএনপির পক্ষে রয়েছে। বিভিন্ন জনমত জরিপের ভিত্তিতে এটি বলা যেতে পারে। তা ছাড়া বিগত ১২ বছরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিগত বোগাস নির্বাচনে তাদের লোকেরাও নৌকায় ভোট দিতে যায়নি। এ আক্ষেপ শীর্ষ নেতৃত্বের।
বিএনপির প্রতিও জনগণের আক্ষেপের শেষ নেই। বিএনপি কেন আন্দোলনের মাধ্যমে নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারল না? তারা কেন একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠনে ব্যর্থ হলো? জনগণের সমস্যাকেন্দ্রিক আন্দোলনের পথ কেন তারা গ্রহণ করল না? ইত্যাদি ধরনের অনেক অভিযোগ রয়েছে জনগণের। শিক্ষিত জনশ্রেণীর একটি অংশ বিশ্বাস করে, বিএনপি নেতৃত্বের কোথাও না কোথাও আপসকামিতা রয়েছে। বিশেষ করে নেতৃত্বের যে মধ্যবর্তী অংশ দীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিল তারা গণআন্দোলন সংগঠনে ব্যর্থ হয়েছে বলে জনগণ মনে করে। প্রবীণ নেতাদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ কম নয়। যারা অতি আবেগপ্রবণ নয় তারা অবশ্য বাস্তবতার কথা বলেন। ১৯৪৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা ৯ মাস বাদে অন্য কোনো সময়ের চেয়ে এই সময়ে রক্তপাত বেশি হয়েছে। দেখামাত্র গুলির আদেশ এ দেশের ইতিহাসে আর কখনোই দেখা যায়নি।
মানববন্ধন কিংবা যেকোনো প্রতিবাদ মিছিল পুলিশের লাঠিপেটার সম্মুখীন হয়নি। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক সময়েও মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা এতটা সঙ্কুচিত হয়নি। এরশাদের আমলেও নির্বাচন এতটা নির্বাসিত হয়নি। নিষ্ঠুর, নিকৃষ্ট অপশাসন দ্বারা গত এক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। এ কেমন দেশ যে দেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে আহূত মিছিলেও ছাত্রলীগ-যুবলীগের লোকেরা হামলা করে? বিগত ১২ বছরে পলিটিক্যাল রিপ্রেশন বা রাজনৈতিক নির্যাতন সীমা লঙ্ঘন করেছে। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা হয়েছে। তারা ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে। এ দেশ নাকি গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে? অথচ অনলাইনে দু’লাইন লিখলে বা সরকারি নেতা-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। রাস্তায় নামলে ঘরে ফেরা দায় হয়ে যায়। এমনকি ঘরে ঘরে হানা দিয়ে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যায়। আর বলে তারা কেউ কিছু জানে না। এমন নির্মম, নিকৃষ্ট অবস্থার মধ্যে কী করে বেরুবে মানুষ? কী করে গোছাবে আন্দোলন? অনেকেই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক দিনগুলোর উদাহরণ দেন। ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ মনে করিয়ে দেন। তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, সে দিন আর এই দিন এক নয়। সময়, সংস্কৃতি ও সঙ্কট নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। সুতরাং নতুন করে ভাবতে হবে। ভীরুতা, কাপুরুষতা নিশ্চয়ই নেতৃত্বের লক্ষণ নয়; কিন্তু এটাও কাম্য নয় যে, অকারণেই কামানের মুখে বুক পেতে দিলেন। প্রতিটি মৃত্যুই অর্থবহ হতে হবে। সুতরাং নতুন কৌশলে, নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে বন্ধুর পথে।