ফেসবুক থেকেঃ
নওগাঁর পাহাড়পুর ইউনিয়নের নুনুজ গ্রামের কুড়িয়ে পাওয়া পরিনাই এখন মা বাবার শেষ ভরসা।
সান্তাহার রেল স্টেশনে কুড়িয়ে পাওয়া সেই মেয়েটির নাম পরিনা। তাঁর পালক বাবা তাঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। আর এই ‘পড়ে পাওয়া’ শব্দের সঙ্গে মিল রেখে তাঁর ফুফু কাদো বেগম মেয়ের ঐ মেয়ের নাম রেখেছিলেন পরিনা। শুধুই ‘পরিনা’ তার আগে বা পরে আর কিছুই নেই।
আর এই পরিনা পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। অনেক সময় ছেলেরা যেটি পারেনা পরিনা মেয়ে হয়ে সেই কাজটি করে দেখান। যেমন অনেক ছেলেই বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশোনা করেন না। পাঠিয়ে দেন বৃদ্ধাশ্রমে।
এই সমাজে পরিনা তাঁর পালক মা-বাবাকে দেখাশোনার জন্য আজ পর্যন্ত বিয়েই করেননি। তিনি ভেবে দেখেছেন, বিয়ে করে পরের ঘরে গিয়ে যদি মা-বাবাকে দেখাশুনা করার সুযোগ না পাই। এমন চিন্তা থেকে তিনি বিয়েই করেননি। কারণ তিনি ছাড়া তাঁর এই বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখার যে আর কেউ নেই।
পরিনার বয়স এখন ২৯ বছর। তিনি ভেবে রেখেছেন, যত দিন আমার মা-বাবা বেঁচে থাকবে তত দিন তাঁদের পাশে থাকবেন। তাঁর চিন্তা কখনো যদি আমার টাকা-পয়সা হয় তাহলে একটা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করবেন। সেখানে অবহেলিত অন্য সব অসহায় মা-বাবার আশ্রয় দিয়ে তাঁদের সেবা করে বাঁকী জীবনটা কাটিয়ে দেবেন।
পরিনার পরিবারের কাছ থেকে জানা যায়, পরিনা যখন শিশু তখন সান্তাহার রেল স্টেশনে কাঁদছিল। তখন তার বয়স ছিল প্রায় ১০ মাস। তাঁর কাঁন্নশুনে স্টেশনে কলার ব্যাপারী আব্দুল ওহাব। শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ‘বাচ্চা কার বলে অনেকবার হাঁকডাক দিলেন। কেউ কোনো সাড়া দিলেন না। দূরে একজন নারী শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। তাঁর কাছে গিয়ে আব্দুল ওহাব বললেন,বাচ্চাটা কি তোমার? মেয়েটি কোনো কথা বললেন না।
দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে আব্দুল ওহাব বললেন, আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলাম। বাচ্চাটা যদি তোমার হয় আর কখনো কোনো দিন যদি বাচ্চাটাকে দেখতে তোমার মন চাই তাহলে আমার বাড়িতে এসে দেখে যেয়ো। এই বলে ঐ মেয়েটিকে তাঁর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে তিনি চলে আসেন। ঠিকানা দিয়ে এলেও ওই নারী কখনো কোনো দিন তাঁর বাড়িতে এই পর্যন্ত মেয়েকে দেখতে আসেননি।
পরিনা বড় হয়ে তাঁর পালক মা-বাবার কাছে এই গল্পই শুনেছেন। পরিনার পালক মায়ের নাম সাহিদা বেগম। তাঁর পালক বাবার বয়স এখন প্রায় ৮৫ বছর। তাঁর মায়ের বয়সও প্রায় কাছাকাছি। পরিনার পালক বাবার বাড়ি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায়। বাবা সান্তাহার স্টেশনে কলা বিক্রি করতে যেতেন। একটু বড় হওয়ার পর পরিনাও বাবার সঙ্গে কালা বিক্রি করতে যেতেন।
আর কলা বিক্রি করে যে কয় টাকা লাভ হতো সেই টাকা দিয়ে পরিনা বাজারে যা খেতে চাইত তার পালক বাবা সেই জিনিসই কিনে দিতেন। কলা বিক্রির পর মেয়েকে ডালার ওপর বসিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। তাঁর পালক বাবার এই ভালোবাসার কথা পরিনা কিছুতেই ভুলতে পারেনা।
মা-বাবার এই ভালোবাসা ছাড়া পরিনার শৈশব জীবন খুবই দুর্বিষহ ছিল। খেলার সাথিদের সঙ্গে খেলতে গেলে তারা পরিনাকে বলত ” তোর মা-বাবার কোন নাম নেই” তোকে কুড়িয়ে এনেছে। এসব কারণে শৈশব জীবনে তাঁর খেলার কোনো সাথি ছিল না। সে কারও সঙ্গে মিশতে পারত না। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরেও সহপাঠীদের কাছ থেকে একই রকম কথা শুনতে শুনতে তাঁর মন খারাপ হতো। তাই কোনোদিন কোন সহপাঠী তাঁর বন্ধু হয়নি। আর এ কারণে বিদ্যালয় তাঁর ভালো লাগত না।
এভাবে পরিনা জামালগঞ্জ ব্র্যাক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে নিজের গ্রামের নুনুজ কলিমিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর জামালগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর টাকার অভাবে আর পরীক্ষা দিতে পারেনি। কারণ সংসারে তখন তাঁর অনেক অভাব। বাবার বয়সের কারণে আর কলা বিক্রি করতে যেতে পারতেন না। মা মানুষের বাড়িতে গিয়ে চেয়ে চিন্তে যা নিয়ে আসতেন তা খেয়ে কোনো রকমে জীবন যাপন করতেন। সংসারে অভাবের কারণে কোনো উপায় না দেখে ২০০৯ সালে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা বেতনে নাটোরে প্রাণ কোম্পানিতে কাজে যোগ দেন। এই চাকরি করতে করতেই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিঘা পতিয়া এমকে কলেজ থেকে ২০১৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজশাহীর নওহাটা ডিগ্রী কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। বর্তমানে তাঁর তৃতীয় বর্ষ চলছে।
পরিনা ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওই কোম্পানিতেই কাজ করতেন। এরপর রাজশাহী শহরের বিসিক এলাকায় একটি নতুন প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি পান। প্রাণে কাজ করার সময় সালেহা খাতুন নামের এক নারীর সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার নন্দনপুর গ্রামে। পরিনাকে আপন বোনের মতো ভালোবাসেন তিনি। পরিনার সঙ্গে তিনিও নতুন প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি নিয়েছিলেন। করোনাকালে দুজনেই চাকরি হারান।
এখন পরিনা তাঁর গ্রামের বাড়ি ও সালেহার বাড়ি দুই জায়গায় থাকেন। দুজনেই চাকরি থাকাকালে কিছু সঞ্চয় করেছিলেন। এখন সেই সঞ্চয় থেকে মাসে ২ হাজার ৭০০ টাকা মুনাফা পান। তা থেকে দেড় হাজার টাকা পরিনা তাঁর মা ও বাবার কাছে পাঠান। আর তাঁরা দুজনে ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে কনো মতে খেয়ে নাখেয়ে পুরো মাস চালান। কাজ খুঁজছেন হন্যে হয়ে।
জীবনের এই কঠিন লড়াইয়ের মধ্যেও পরিনা লেখালেখির অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর বেশ যোগাযোগ। ঢাকায় গেলে কবি নির্মলেন্দু গুণের বাসায় যান তিনি। পরিনার লেখা ৬টি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি গানও লেখেন। কণ্ঠশিল্পী রিংকু তাঁর লেখা গান করেছেন। নিয়মিত একটি অনলাইন পত্রিকায় লেখেন তিনি। যদিও লেখালেখি থেকে এখনো তাঁর কোনো আয় হয় না।
নারী-পুরুষ নয়, তিনি নিজেকে মানুষ ভাবতে ভালোবাসেন। মানবতাবিরোধী যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ করেন। এখন তাঁর খুব দুঃসময় যাচ্ছে। প্রায় নুনভাত খেয়ে থাকেন। গরুর মাংসের কেজি যখন ২৫০ টাকা ছিল, তখন আধা কেজি মাংস কিনেছেন। পেঁয়াজ– রসুনের দাম বেড়ে গেলে তা বাদ দিয়ে রান্না করে খান তিনি। মা-বাবার কাছে বেশি টাকা পাঠাতে পারেন না। তাতেও তাঁর দুঃখ নেই। দুঃখ হচ্ছে, তিনি জানেন না, তাঁর আসল মা-বাবাকে। এ জন্য তাঁর কষ্ট হয়, হয়তো মা-বাবা তাঁর পাশ দিয়েই হেঁটে যান আর মেয়েকে দেখেনও অচেনা চঁখে।
তার এই দুঃখ ও কষ্টের কথা শুনে বদলগাছী উপজেলার নির্বাহী অফিসার আবু তাহির এর নির্দেশে সমাজসেবা অফিসার তারিকুল ইসলাম তার পালিত বাবার নামে একটি বয়স্কভাতার কার্ড তৈরি করেদেন। এবং সেই কার্ডটি গত রোববার (১নভেম্বর) উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সমাজসেবা অফিসার আব্দুল ওহাব এর পালিত কন্যা পরিনার হাতে তুলে দেন।
বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, পালিত কন্যার পরিচয়কে উর্দ্ধে রেখে শত শত বাধা অতিক্রম করে অশীতিপর পিতা-মাতাকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের নুনুজ গ্রামের পরিনা। তাঁর এই আদর্শ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর পালিত পিতার নামে একটি বয়স্কভাতার কার্ড তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এবং তাঁর পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি একটি বাড়ি উপহার দেওয়া হবে।
লেখকের আবেদন: পরিশেষে তার একটি সরকারী বা বেসরকারি চাকুরী দেওয়ার জন্য বিত্তবান ব্যবয়াসী ও ইন্ডাষ্টির মালিকদের প্রতি অনুরোধ রইল।
-শিশির