অর্থনীতিঃ
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইএ) রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্ত-মধ্য-মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান চাপ প্রয়োগের সংস্কৃতি বন্ধ করে বিত্তবান-ধনীদের ওপর যুক্তিসঙ্গত চাপ প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছে।

বিইএ বলেছে, করোনা-উদ্ভ‚ত বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে জাতীয় বাজেটের জন্য সম্পদ আহরণ করতে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে ধনী ও বিত্ত-সম্পদশালী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান, যারা সম্পদ-আয় ও মুনাফার অর্থমূল্য কম প্রদর্শনের মাধ্যমে সঠিক কর প্রদান করে না, তারা যেন সঠিক পরিমাণ কর প্রদান করে, তা শক্তভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে প্রাক্-বাজেট এক আলোচনা সভায় বিইএ নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির চারবারের নির্বাচিত সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত-এর নেতৃত্বে কার্যনির্বাহক কমিটির একটি প্রতিনিধি দল গতকাল বুধবার ‘২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ভিত্তিনীতি: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবনা’ শীর্ষক লিখিত প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে হস্তান্তর করেছে। সেগুনবাগিচার এনবিআর সম্মেলনকক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম সমিতির পক্ষে লিখিত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।
প্রস্তাবনায় অর্থনীতি সমিতি বাজেট প্রণয়ণের ক্ষেত্রে সরকারকে চারমাত্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ওপর জোর দিতে বলেছে। কারণ, অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং কভিড-১৯ এর কারণে বিশে^র সব দেশই এখন অর্থনৈতিক-সামাজিক-শিক্ষাগত-স্বাস্থ্যগত-রাজনৈতিক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় মুক্তবাজার আর কর্পোরেট-স্বার্থীয় সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি বাস্তবায়নের গতানুগতিকতায় সীমাবদ্ধ থাকলে বাংলাদেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও বৈষম্য-অসমতা এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য কোনোভাইে দূর হবে না।

সমিতির মতে, এমনিতেই করোনার প্রভাবে ‘নিরঙ্কুশ দরিদ্র’ মানুষ ‘হতদরিদ্র-চরম দরিদ্র’ এবং দরিদ্র, নি¤œবিত্ত, নি¤œ-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাপকাংশ দরিদ্রতর হয়েছে। কর্মবাজার ভীষণভাবে সংকুচিত ও বিপর্যস্ত। তার মধ্যে সাধারণ মানুষের ওপর নতুন খড়্গ হয়ে নেমে এসেছে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি। এসব মিলিয়ে বৈষম্য নিরূপণের মাপকাঠি গিনি সহগ ও পালমা অনুপাত অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন উচ্চ ও বিপজ্জনক আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে।

সমিতি বলছে, কভিড-১৯ উদ্ভূত লকডাউন ও বিধি-নিষেধে নিঃস্ব, সর্বস্বহারা, হতাশাগ্রস্ত, ভাগ্যনির্ভর মানুষের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে আয়-সম্পদ-স্বাস্থ্য-শিক্ষা বৈষম্য হ্রাসের যত পথ-পদ্ধতি আছে, তা প্রয়োগ করে সবার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভাইরাসপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এর জন্য আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটকে কোনোভাইে সংকোচনমূলক না করে বরং সম্প্রসারণশীল ও বৃহদাকারভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যা করা খুবই

সম্ভব। শুধু প্রয়োজন আয়-ধন-সম্পদের বণ্টনকে ন্যায্য করা, অর্থাৎ ধনীদের কাছ থেকে তা প্রবাহিত করতে হবে দরিদ্র, বিত্তহীন, নি¤œবিত্ত মানুষের দিকে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে দরিদ্রদের ওপর প্রত্যক্ষ করের বোঝা না বাড়িয়ে ধনী-বিত্তশালীদের ওপর সম্পদ কর আরোপ করতে হবে, সুপার-ডুপার ধনীদের ওপর করের হার বাড়াতে হবে এবং ৮০ শতাংশ শেয়ার-বন্ডের মালিক গুটিকয়েক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বড় বড় বিনিয়োগের ওপর সম্পদ কর আরোপ করতে হবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর আরোপ এবং কালো টাকা ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করতে নিতে হবে বলিষ্ঠ পদেক্ষপ। দেশপ্রেম ও সদিচ্ছা থাকলে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা কঠিন কিছু নয়।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পরোক্ষ করের বোঝা মূলত দরিদ্র-প্রান্তিক-নিম্নবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্তদের ওপর তাদের আয়ের তুলনায় অধিক হারে চাপ প্রয়োগ করে; ফলে তা দারিদ্র্য-বৈষম্য হ্রাস না করে উল্টো আরও বাড়িয়ে দেয়। সে কারণে পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের অনুপাত বেশি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

কর-রাজস্ব ও করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের সেইসব খাত ও ক্ষেত্রকে অনুসন্ধান করা উচিত, যেখান থেকে আয়করের কথা কখনো ভাবা হয় না (যেমন সম্পদ কর, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর, কালোটাকা উদ্ধার, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার ইত্যাদি) এবং যেসব খাত থেকে কোনো আয়ই আসে না, অথচ প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেক। একটু সাহসী ও উদ্যমী হলে সহজেই কর-রাজস্ব ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা যায়।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মতে, বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ যৌক্তিক, নৈতিক, মানবিক সব বিচারেই সম্ভব। আর এর জন্য সরকারকে বাজেট প্রণয়নে সংবিধানের বিধানসমূহকে মৌলভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়া-উদারবাদী দর্শনের বিপরীতে থেকে অধিকতর সক্রিয় ও ফলপ্রদ ভ‚মিকা নিতে হবে।

বাজেটে সরকারের আয় ও ব্যয় খাতের কাঠামোগত রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করা জরুরি। আমদানি শুল্ক হার নির্ধারণে দেশজ শিল্পায়ন ও দেশজ কৃষির স্বার্থ বিবেচনায় কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ খাত-উপখাতসমূহের ক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়া মুক্তবাজার দর্শনের বিপরীতে সংরক্ষণবাদ নীতি-দর্শন প্রয়োগ করতে হবে। কারণ, ধনী দেশের যারা নানা প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে, তারা কিন্তু সম্ভাব্য সবধরনের সংরক্ষণবাদ নীতি অবলম্বন করেই ধনী হয়েছে। কিন্তু ধনী হওয়ার পরে ‘উপরে ওঠার মইটি লাথি মেরে সরিয়ে’ মুক্তবাজারে বাংলাদেশকে খেলতে বলছে—এসবই হলো দ্বিচারিতা।

-শিশির

FacebookTwitter

About Bangla Daily

একটি পরিপূর্ণ বাংলা অনলাইন পত্রিকা। মাতৃভাষার দেশ বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সস্প্রচারিত হচ্ছে।

View all posts by Bangla Daily