মিলি ‍সুলতানা, কুইন্স, নিউইয়র্ক থেকেঃ
মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের (বীর উত্তম) যখন পা হারালেন, তখন তিনি ভেঙে পড়েননি। সেদিন তিনি স্ত্রী লুৎফাকে বলেছেন, “দেশের জন্য আমার সামান্য একটা পা উৎসর্গ করেছি। তেমন বেশি কিছু তো হারাইনি। একটা পা গেছে, জীবন তো যায়নি………..।’

ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম কর্নেল আবু তাহেরকে। দেশপ্রেমিক এই মানুষটাকে এক পলকেই দেশদ্রোহী বানিয়ে দিয়েছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারিগর ছিলেন জিয়াই। তারই নীলনকশা অনুযায়ী অত্যন্ত গোপনে দ্রুততার সাথে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করা হয়েছিল।

তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আগের দিন স্ত্রী লুৎফার সাথে দেখা হয়েছিল তাঁর। কিন্তু লুৎফা জানতেন না এটাই স্বামীর সাথে তাঁর শেষ দেখা।দিনটি ছিল ১৯৭৬ সালের ১৯ জুলাই । কর্নেল তাহেরকে খুব প্রাণবন্ত লাগছিল। স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, “ক্ষুদিরামের পর এভাবে আমারই প্রথম ফাঁসি হচ্ছে। আমার জন্য গৌরববোধ করতে পারো।”—- কি মর্মান্তিক কথা!! লুৎফা তাহের বুঝতেও পারেননি, পরদিনই তাহেরের ফাঁসি হবে। তিনি ভেবেছিলেন, রায় পরিবর্তিত হয়ে হয়ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।

ছিয়াত্তরের ২০ জুলাই দিবাগত রাতটা তাহের-পরিবারের জীবনে এই রকম নিকষ কালো রাত আর আসেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাহেরের লাশ নিয়ে যেতে।স্ত্রী লুৎফার মনে ভেসে উঠছে গত দিনের উচ্ছল তাহেরের মুখচ্ছবি। এখন দেখতে হবে লাশ! ২৪ ঘণ্টা আগে যিনি ছিলেন মানুষ, তিনিই এখন লাশ!

মেজর জেনারেল জিয়ার নির্দেশ এল, দাফন করতে হবে গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু কীভাবে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে অত দূর! তখন যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল নাজুক। শাশুড়ি ভাসুরকে নিয়ে লুৎফা গিয়েছিলেন লাশ আনতে। ওই নির্দেশের পর ভাসুর আরিফুর রহমান ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘লাশের নিরাপত্তা দেবে কে? আপনারা ওকে মেরেছেন, আপনারাই নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।”

তখন স্বরাষ্ট্র সচিব কথা বললেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সঙ্গে। ব্যবস্থা হলো হেলিকপ্টারের। তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাড থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলো বেলা আড়াইটায়। সেনাসদস্যরাই গাড়িতে করে তাহের-পরিবারকে নিয়ে গেলেন হেলিপ্যাডে। লাশ ওঠানোর আগেই লুৎফার শাশুড়ি, তাহেরের ভাইবোন, লুৎফা, আইনজীবী জিন্নাত আলী, আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী এবং জয়া উঠলেন হেলিকপ্টারে। একটি খাটিয়ায় করে নিয়ে আসা হয়েছিল তাহেরের লাশ। ছিল বাতাস।হেলিপ্যাডে রাখা লাশের মাথার চুল উড়ছে। একটা পা বেরিয়ে আছে। তাহেরের বৃদ্ধা মা চিৎকার করে বললেন, “আমার ছেলের জন্য একটা কফিনও হলো না?” তাহেরের কবর হলো গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলার কাজলার পারিবারিক কবরস্থানে। ২১ দিন সেনাসদস্যরা পাহারা দিয়ে রাখলো সেই কবর।

-এস

FacebookTwitter

About Bangla Daily

একটি পরিপূর্ণ বাংলা অনলাইন পত্রিকা। মাতৃভাষার দেশ বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সস্প্রচারিত হচ্ছে।

View all posts by Bangla Daily