ডেস্ক রিপোর্টঃ
আসল নাম ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে চিকিৎসক হিসেবে তার নিবন্ধন আইডি ১১১৬৭৯। তিনি কখনো ব্যবহার করতেন ডা. সাবরিনা এ চৌধুরী, কখনো আবার সাবরিনা আরিফ চৌধুরী বা সাবরিনা মিষ্টি চৌধুরী নাম। রাজধানীর শেরে বাংলানগরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ও কার্ডিয়াক সার্জন তিনি। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেকেজি (জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা) হেলথ কেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফুল হক চৌধুরীর চতুর্থ স্ত্রী তিনি। সাবরিনা সরকারি কর্মচারী হয়েও জেকেজি হেলথ কেয়ার ও ওভাল গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। সাবরিনা যেমন আরিফের চতুর্থ স্ত্রী তেমনি আরিফও সাবরিনার দ্বিতীয় স্বামী। সাবরিনার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে। তার বাবা সাবেক সচিব সৈয়দ মোশাররফ হোসেন। তিনি ঢাকার শ্যামলীর পিসি কালচার রোডের নিজ বাড়িতে বসবাস করেন। তার দুই মেয়ের মধ্যে ডা. সাবরিনা বড়। সাবরিনা ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে এসএসসি ও পরে এইচএসসি পাস করেন। এরপর এমবিবিএস পাস করেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে। সাবরিনার প্রথম স্বামীর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, তিনি টেলিফোন সেবা সংক্রান্ত একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। সাবরিনা ২৭তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারের চাকরি পাওয়ার পর তার প্রথম পোস্টিং হয় দিনাজপুরে। পরে বদলি হয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে যোগ দেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।
ডা. সাবরিনা বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনার পরিচিত মুখ। বিভিন্ন টকশোতেও স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনায় নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি। দিতেন সুস্থ থাকা ও করোনামুক্ত থাকা এবং প্রতিরোধের নানা টিপস। তার প্রতিষ্ঠানে করোনা সনদ জালিয়াতির তথ্য ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে এখন আলোচনায় তিনি। গতকাল রবিবার পুলিশ তাকে পাকড়াও করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডা. সাবরিনার তদবিরেই করোনা শুরুর প্রথম দিকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে নমুনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি। তাদের প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ঠিকাদারির কাজও করত। সারা দেশে ৪৪টি বুথ বসিয়ে ও বাসাবাড়িতে গিয়ে তারা কমপক্ষে ২৭ হাজার নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৬ হাজার ভুয়া সনদ বিতরণের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিটি সনদের জন্য বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ও বিদেশিদের কাছ থেকে ১০০ ডলার করে নিত জেকেজি।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, আরিফের সঙ্গে বিয়ের পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাবরিনা। দুজনে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ঠিকাদারি কাজ পেতে নানামুখী তদবির করেন সাবরিনা। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর কয়েকজন নেতাকে কাজে লাগান বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জেকেজিকে নমুনা সংগ্রহের কাজ দেওয়া প্রসঙ্গে গত শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয়) ডা. জাহাঙ্গীর কবির স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সমন্বয়ক আরিফুল ওভাল গ্রুপ লিমিটেড নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপেরও স্বত্বাধিকারী। ওভাল গ্রুপ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ-২০১৮-এ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে। চিকিৎসা পেশাজীবীদের সংগঠন বিএমএ’রও একাধিক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে তারা। কভিড-১৯ সংকট শুরুর পর আরিফুল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানান, জেকেজি গ্রুপ দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলে দেশে কিছু বুথ স্থাপন করতে চায়। এসব বুথের মাধ্যমে পিসিআর পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পিসিআর ল্যাবরেটরিগুলোকে সরবরাহ করবে। এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সরকারকে কোনো অর্থ দিতে হবে না। ধারণাটি ভালো এবং কভিড পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এ বিবেচনা থেকে ওভাল গ্রুপের সঙ্গে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় জেকেজি গ্রুপকে অনুমতি দেওয়া যায় বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনে হয়।
নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল সাবরিনার :
সিনেমার নায়িকা হওয়ার তীব্র বাসনা ছিল ডা. সাবরিনার। ২০১৬ সালে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। সাবরিনা বলেন, ‘নায়িকা হতে চেয়েছিলাম একসময়। কিন্তু বাবার কড়া শাসনের কারণে আর সেটি হয়ে ওঠেনি। নায়িকা হওয়ার জন্য প্রস্তাবও পেয়েছিলাম। লুকিয়ে অভিনয়ের রিহার্সেলে যেতাম। তবে যেদিন ফাইনাল শ্যুটিং হবে সেদিন বাবা বুঝে গেছেন সবকিছু। আমার আর অভিনয় করা হলো না!’
ওভাল গ্রুপেরও চেয়ারম্যান ছিলেন সাবরিনা : শুধু জেকেজি-ই নয়, দ্বিতীয় স্বামীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ওভাল গ্রুপেরও চেয়ারম্যান ছিলেন ডা. সাবরিনা। আরিফ গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে ওভাল গ্রুপের ওয়েবসাইট ডাউন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ওভাল গ্রুপের ঢাকা এক্সপো-২০১৯ নামে একটি ওয়েবসাইটে ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে ওভাল গ্রুপের চেয়ারম্যান পরিচয় দেওয়া হয়েছে। সেখানে ১১ বার চেয়ারম্যান হিসেবে তার নাম লেখা হয়েছে। ওভাল গ্রুপের প্রোফাইলেও চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছে সাবরিনার নাম।
গ্রেপ্তার এড়াতে নানামুখী তৎপরতা : স্বামী আরিফুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর করোনা সনদ জালিয়াতির সঙ্গে ডা. সাবরিনার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর নানা মাধ্যমে গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। বিষয়টি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ ও তেজগাঁও থানার একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তড়িঘড়ি তালাক নোটিস পাঠান তিনি। এরপর গতকাল পর্যন্ত নিয়মিত অফিসে যান তিনি। জানা গেছে, বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর বিষয়ে সহযোগিতা চান তিনি। এজন্য বিএমএ ও স্বাচিপের একাধিক নেতাও তার পক্ষে তবদির করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডা. সাবরিনা শনিবার দুপুর ২টার দিকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রামপদ সরকারের কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে উপস্থিত দুজন সাংবাদিক তাকে ওই কক্ষে প্রবেশ করতে দেখেন। এরপর আরও ৪-৫ জন চিকিৎসক সেখানে যান। তাদের সবার মুখে মাস্ক থাকায় পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সাবরিনা ও তার সহকর্মীরা রামপদ সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে রামপদ সরকার বলেন, করোনা সনদ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত নয় এমন দাবি করে তিনি (ডা. সাবরিনা) তার সহযোগিতা চান।
যেভাবে পুলিশের হেফাজতে সাবরিনা :
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্নজনকে করোনা টেস্টের ভুয়া ফল দেওয়ার অভিযোগ পায় পুলিশ। তদন্তে দেখা যায়, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নেওয়ার দাবি করা ‘বুকিং বিডি’ ও ‘হেলথকেয়ার’ নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিয়ে নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকারের অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীকে নকল সনদ দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবেক গ্রাফিক ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী জেকেজির নার্স ও মাঠ সমন্বয়ক তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা জেকেজি থেকে চাকরিচ্যুত। জেকেজি করোনার ভুয়া সনদ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত। ভুয়া সনদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাড়তি অর্থ দাবি করায় প্রতিষ্ঠানটি থেকে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। এ বিষয়ে হিরু ও তানজীন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিশদ অনুসন্ধানে নামে তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ। এরপর গত ২৩ জুন গ্রেপ্তার করা হয় জেকেজির সিইও আরিফুলকে। তিনি থানা হেফাজতে ও রিমান্ডে থাকা অবস্থায় জেকেজির কর্মীরা থানায় হামলা করে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, আরিফুলকে গ্রেপ্তারের পর জেকেজির দপ্তর থেকে উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপে করোনা পরীক্ষার ১৬ হাজার ভুয়া সনদ দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আরিফুলের স্ত্রী ডা. সাবরিনার নাম আসে। তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চার মামলার এজাহারে ডা. সাবরিনাকে আসামি না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জেকেজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করেন ডা. সাবরিনা। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তার স্বামী আরিফুল নিজেই বিষয়টি স্বীকার করেন।’
হারুন আরও বলেন, ‘জেকেজির যেসব সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদে তাদের সবাই বলেছেন, সাবরিনা জেকেজির চেয়ারম্যান। তাছাড়া তেজগাঁও কলেজে জেকেজির বুথে হামলার অভিযোগ উঠলে সাবরিনাই প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র হিসেবে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দেন। তিনি তেজগাঁও কলেজে মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন। তাছাড়া সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কখনই কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না।’
-কেএম