অনলাইনঃ
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারি রোধে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়। ২৬ মার্চ, বৃহস্পতিবার থেকে এই ছুটি শুরু হয়।
দীর্ঘ এই ছুটি পেয়ে মানুষ যাত্রীবাহী বাস, লঞ্চ ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেও বিকল্প পথে হাজারো মানুষ বাড়ি ফিরছেন। এতে করে গ্রামে তৈরি হয়েছে করেনায় সংক্রমণের ঝুঁকি।
বিদেশফেরত প্রবাসীরা গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছেন। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেয়া হলেও বেশিরভাগ তা না মেনে সর্বত্র ঘোরাঘুরি করছেন। এ কারণে সরকার সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়। সমকাল’র এক বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েকদিনে হোমে কোয়ারেন্টাইনের শর্ত না মানায় বহু মানুষকে জরিমানা করা হয়। এরপর বিদেশফেরতদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের বাড়ি গিয়ে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু বিদেশফেরতরা ঠিকানা হিসেবে যেসব স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন, সেখানে গিয়ে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তারা অন্য কোথাও থাকছেন।
এর মধ্যে সরকার ঘোষিত ১০ দিনের ছুটি পেয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে হাজারো মানুষ গ্রামে ফিরেছেন। এতে রাজধানী ফাঁকা হলেও গ্রামকে তারাও করেছেন অনিরাপদ। এমতাবস্থায় গ্রামকেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাস ইস্যুতে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো অনেক বিলম্বে এসেছে। বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে না পারা সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চরম অবহেলা ও ব্যর্থতা।
প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে সবাইকে যেহেতু রাখা যাবে না, সুতরাং তাদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সেটিতেও ব্যর্থতার পরিচয় মিলেছে। এখন টানা ১০ দিন ছুটি ঘোষণার পর মানুষ ইচ্ছামতো গ্রামে ছুটছেন। যেন বাধা দেয়ার কেউ নেই। গ্রামে যাওয়ার পথে এসব মানুষ অন্যদের সঙ্গে মিশেছেন, আবার গ্রামে ফিরেও পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সংস্পর্শে যাবেন। এভাবে কী করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে? এখন গ্রামেও ঝুঁকি তৈরি হলো।’ এখন জরুরি ভিত্তিতে গ্রামে ফেরা এসব মানুষের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
বিএসএমএমইউ’র মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও করোনা প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘গ্রামে হাজারো মানুষ ফিরে যাওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। তবে এখন তাদের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা প্রতিরোধে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, সেগুলোর যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ, বাড়িতে ফিরে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে দূরত্বে রাখতে হবে।’
গ্রামে ফেরত যাওয়াদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘পৃথক কক্ষে অবস্থান করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখুন। অন্তত ১৪ দিন বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। এসব বিষয় না মানলে নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য মা-বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ প্রতিবেশী সবার জন্য ঝুঁকি তৈরি হবে। সর্বোপরি দেশের সবার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে নিজে নিরাপদ থাকুন, সবাইকে নিরাপদ রাখুন।’
ব্যাপকসংখ্যায় মানুষ গ্রামে যাওয়ায় ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
এ বিষয়ে ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ছুটি পেয়ে গ্রামে ফেরা মানুষগুলো কিছুটা ঝুঁকি তৈরি করেছে- এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, সবাই যেন বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত পুরোপুরি মেনে চলেন। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে পৃথকভাবে অবস্থান করতে হবে। অন্যথায় রোগটি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে আমরা এই রোগটি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। সুতরাং সবাইকে এই নির্দেশনাটি মেনে চলতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত চার লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৩ দেশি-বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন মাত্র ৪৭ হাজার ৩৬১ জন। এর মানে, ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ নিময় মেনে ঘরে থাকছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জনরা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে জানান, তালিকায় থাকা বিদেশফেরত বেশিরভাগ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বিদেশফেরতরা ঠিকানা হিসেবে যেসব স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন, সেখানে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। তারা অন্যত্র থাকছেন।
এদিকে কয়েকটি জেলার অভিযোগ, বিদেশফেরতদের একটি বড় অংশ সামাজিক দূরত্ব না মেনে ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি করছে। তাদের সবাইকে খুঁজে বের করা প্রশাসনের পক্ষে কঠিন ব্যাপার। ইতোমধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সারাদেশে সেনাবাহিনী কাজ করছে। আগে থেকে পুলিশ বাহিনী মাঠে ছিল।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পুরো বিশ্বই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে সবকিছু সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষকে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। যদি এসব নির্দেশনা মেনে না চলেন, তাহলে ঝুঁকি তৈরি হবে। সেটি সবাইকে বুঝতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার সবাইকে রক্ষা করতে চায়। যেমন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেয়া হলো, কিন্তু অনেকে তা মানলেন না। এর মধ্য দিয়ে নিজের পাশাপাশি পরিবার, প্রতিবেশী ও দেশের মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেললেন। এরপর পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাঠিয়ে খুঁজে বের করতে হচ্ছে। অনেককে জরিমানা করা হয়েছে। এটি সত্যিই দুঃখজনক। সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, আপনারা প্রত্যেকে হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত মেনে চলুন।’
-ডিকে