অনলাইন ডেস্কঃ
সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জোরদার করতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রত্যয়ে বিএনপি, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের অভিন্ন দাবি ও লক্ষ্যের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
গতকাল তিন পক্ষের নেতাদের বৈঠকে এ খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। শীর্ষ নেতারা আলোচনা করে আজ তা প্রকাশ করতে পারেন। গতকাল বিকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে অভিন্ন সাত দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্যের খসড়া নিয়ে নেতারা আলোচনা করেন।
বৈঠকে তা চূড়ান্ত হলেও আজ শীর্ষ নেতারা আলোচনা করে এর ঘোষণা দেবেন। প্রয়োজনে তারা খসড়া সংশোধনও করতে পারেন। এদিকে নতুন জোটের নামও আপাতত চূড়ান্ত করে রেখেছেন নেতারা। কয়েকটি বিকল্প নাম রাখা হয়েছে।
তবে জোটের নাম হিসেবে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট এর প্রস্তাব এসেছে বেশি।
জোটের নামও শীর্ষ নেতারা ঘোষণা দেবেন। বিকাল সাড়ে তিনটায় শুরু হওয়া বৈঠক সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। বৈঠক শেষে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে একটি আন্দোলন করার জন্য কতগুলো দাবি ও আন্দোলনের মাধ্যমে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই সে বিষয়ে আলোচনা করেছি।
আজকের বৈঠকে আমাদের দাবি ও লক্ষ্যের খসড়া নির্ধারণ করেছি। শনিবার এই দাবি ও লক্ষ্য চূড়ান্ত করে সেগুলো গণমাধ্যমের সামনে ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, আমরা বেশ কয়েকদিন ধরে বেশকিছু কাজ-কর্ম করছিলাম। একটা আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অভিন্ন দাবি নির্ধারণ করার চেষ্টা করছিলাম। আন্দোলনের মাধ্যমে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাব সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করছিলাম। যারা আমাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তাদের আলাদা প্রস্তাব ছিল, আজকের বৈঠকে তারা তা উপস্থাপন করেছেন। সবাই মিলে বৈঠকে অভিন্ন দাবি ও লক্ষ্যের একটা খসড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। শনিবার এটা চূড়ান্ত করব। এরপর আপনাদের সামনে এটা উপস্থাপন করব।
আজ আমাদের ঘোষণা দেয়ার মতো আর তেমন কিছু নেই। আমরা মনে করি এটা একটা খুব বড় রকম অগ্রযাত্রা। আমরা আমাদের মূল দাবি, ঘোষণা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পেরেছি। শনিবার শুধু একটা ফরমালিটি বাকি আছে। সেটা শেষ করার পরে আমরা আপনাদের সামনে হাজির করব।
বৈঠকে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন, জেএসডি সহ-সভাপতি তানিয়া রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, নাগরিক ঐক্যের প্রধান সমন্বয়ক শহীদুল্লাহ কায়সার, কেন্দ্রীয় নেতা ডা. জাহিদ, বিকল্প ধারা যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক একটি সূত্র জানায়, ঐক্যের সাতটি দাবির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। দাবিগুলো হলো-
১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে হবে।
২. যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
৩. বাক্, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সকল রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
৪. কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের অভিযোগে ছাত্র-ছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল কালো আইন বাতিল করতে হবে।
৫. নির্বাচনের ১০ দিন পূর্ব থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণে পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত করতে হবে।
৬. নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাদের ওপর কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ না করা। নির্বাচনকালীন সময়ে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।
৭. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোনো ধরনের মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
এছাড়া ঐক্যের ১১টি লক্ষ্যের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো-
১. মুক্তি সংগ্রামের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যমান স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থার অবসান করে সুশাসন, ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা। এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানকল্পে সংসদে, সরকারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নসহ প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা।
২. ৭০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের যুগোপযোগী সংশোধন করা। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাসহ সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দানের জন্য ‘সাংবিধানিক কমিশন’ গঠন করা।
৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৪. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতিকে কঠোর হাতে দমন এবং ইতিপূর্বে দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।
৫. দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতাসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে মেধাকে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় কোটা সংস্কার করা।
৬. সকল নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চয়তার বিধান করা। কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা। নারীর সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।
৭. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার সাধন করা।
৮. রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক স্বচ্ছতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শৃঙ্খলা নিশ্চিত, জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। নিম্নআয়ের নাগরিকদের মানবিক জীবনমান নিশ্চিত করা এবং দ্রব্য মূল্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বেতন-মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা।
৯. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেয়া।
১০. সকল দেশের সাথে বন্ধুত্ব-কারো সাথে শত্রুতা নয় এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা এবং প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১১. বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত ও পুনর্বাসনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়। এর আগে ৭ ও ৮ই অক্টোবর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাসা ও আ স ম রবের বাসায় বৈঠক করেন নেতারা। সর্বশেষ বৈঠকে ঐক্যের লক্ষ্যে বিএনপি, ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের লক্ষ্য ও দাবিগুলো সমন্বয় করতে জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ও গণফোরামের আ অ ম শফিক উল্লাহকে দায়িত্ব দেয়া হয়। গতকালের বৈঠকে তারা সাত দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য উপস্থাপন করেন।
ভেতরে বৈঠক, বাইরে আওয়ামী লীগের মিছিল: এদিকে আ স ম আবদুর রবের বাসায় বৈঠক চলাকালে বাইরে মিছিল করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বৈঠক চলাকালে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে সরকারি দলের ৩০ থেকে ৪০ জন নেতাকর্মী রবের বাড়ির সামনে দফায় দফায় মিছিল করেন। মিছিলটি উত্তরা রাজলক্ষ্মীর দিক থেকে এসে ৪ নম্বর সড়কের প্রায় শেষ মাথা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসে। তিনবার আ স ম আবদুর রবের বাসার সামনে দিয়ে মিছিলটি প্রদক্ষিণ করে। শেষবার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা। পরে তারা মিছিল নিয়ে রাজলক্ষ্মীর দিকে চলে যান। মিছিল থেকে তারা ‘একাত্তরের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান, বাড়াবাড়ি করিস না, পিঠের চামড়া থাকবে না সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
-আরবি