অনলাইনঃ
এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারকে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন সফররত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কিটতত্ত্ববিদ ডা. ভূপেন্দর নাগপাল।
তবে এসব পরামর্শের সঙ্গে মিল নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এডিস নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডের।
বিশেষ করে উড়ন্ত এডিস মশা নিধন (অ্যাডাল্টিসাইড) ও এডিসের লার্ভা ধ্বংসে (লার্ভাসাইড) সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত ওষুধ ও পদ্ধতির মধ্যে ব্যাপক অসামঞ্জস্য উঠে এসেছে।
এমনকি এডিস মশার প্রজননের জন্য যেসব স্থান এতদিন চিহ্নিত করে এসেছে দুই সিটি করপোরেশন, এই আন্তর্জাতিক কিটতত্ত্ববিদের তথ্যের সঙ্গে তা মেলেনি। তিনি এডিস মশার বৈশিষ্ট্য নিয়েও বেশকিছু তথ্য দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নাগপালের ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এর আগে তিনি ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন। উনি মূলত পরামর্শ দিচ্ছেন কীভাবে আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ইতোমধ্যেই উনি আমাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা সে অনুযায়ী কাজ শুরু করছি।
ডা. ভি নাগপাল জানিয়েছেন, একটি এডিস মশার ডিম থেকে লার্ভা হতে সময় লাগে দুই-তিন দিন। লার্ভা থেকে চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই এডিসের বাচ্চা হয়। বাচ্চা দুয়েক দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয়।
এডিস মশা দুই প্রজাতির এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। অ্যালবোপিকটাস সাধারণত গ্রামাঞ্চলে থাকে, তবে শহরেও থাকতে পারে। ইজিপটাই থাকে শহরাঞ্চলে ও এর প্রকোপই বেশি লক্ষ করা যায়। দুই প্রজাতির এডিস মশার ডিম পাড়ার আচরণ একই রকম। অনেক দিন কৃত্রিম পাত্রে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। এই দুই প্রজাতির স্ত্রী মশা মূলত ডেঙ্গুজরের ভাইরাস বহন করে এবং এদের মাধ্যমেই ডেঙ্গুজ্বর একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়।
এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। বিশেষ করে সকাল বেলার প্রথম দিকে এবং বিকেল বেলার শেষদিকে অর্থাৎ সন্ধ্যার শুরুতে এডিস মশা বেশি কামড়ায়।
এই দুই মশার মধ্যে পার্থক্য হলো এডিস ইজিপটাই পিঠে বীণার মতো চিহ্ন থাকে। আর এডিস অ্যালবোপিকটাসের মশার পিঠে সাদা রডের মতো অংশ থাকে। এ দুই ধরনের মশার শরীরে কালো-সাদা ডোরাকাটা দাগ থাকে। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই মশাগুলোর।
প্লেন, ট্রেন বা যেকোনো গণপরিবহনে করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র চলেও যেতে পারে।
বাতাস কম ও তাপমাত্রা বেশি এমন জায়গায় এডিস থাকে। দিনের বেলায় এ মশা ঘরের অন্ধকার কোনায়, বিশেষ করে আসবাবপত্রের নিচে ও ঝুলন্ত পোশাকের নিচে থাকতে পছন্দ করে।
ভি নাগপাল আরো জানান, মানুষের শরীর থেকে রক্ত খায় স্ত্রী এডিস মশা। পুরুষ এডিস মশা রক্ত খায় না। সাধারণত সূর্যাস্তের পরপরই এবং দুই ঘণ্টা আগে এডিস মশা কামড়ায়। এডিস মশা সর্বোচ্চ ৩-৪ মিটার উড়তে পারে।
সাধারত একটি স্ত্রী এডিস মশা ৬-১০০টি ডিম পাড়ে। এই ডিম কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছরেও নষ্ট হয় না। যখন ডিমের পাত্রটি পানিতে ভরে যায় তখনই ডিম থেকে লার্ভা হয়। শুষ্ক মৌসুমে এই মশা অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারে। একটি পুরুষ এডিস মশা ১০ দিন বাঁচে আর স্ত্রী মশা চার-ছয় সপ্তাহ। সংখ্যায় সামান্য হলেও এই মশার বংশবৃদ্ধি দ্রুত হয়।
এতদিন ধারণা করা হতো এডিস মশা বাসাবাড়ি ও আশপাশে জমে থাকা পানিতে বেশি থাকে। কিন্তু ভি নাগপাল জানান, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি থাকে সরকারি পরিবহন পুলে। এসব জায়গায় সারিবদ্ধ গাড়ি, টায়ার ও পরিত্যক্ত টিউব যন্ত্রপাতিতে এডিসের বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে। এর পরপরই এডিস থাকে হাসপাতালের নিচে খোলা জায়গায়, ছাদে, পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রে। এরপর বেশি থাকে পুলিশের পরিবহন পুলে ও আটকের পর পুলিশ যেখানে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন স্তূপ করে রাখে।
এছাড়া বিমানবন্দরের চৌবাচ্চা ও রানওয়ের আশপাশে, পার্ক, নার্সারি, ফোয়ারা, সিভিল ডিপার্টমেন্টের নির্মাণাধীন ভবনে। সরকারি অফিসগুলো এডিসের বিস্তার বেশি। এছাড়া বাসাবাড়ির গ্যারেজে, বাড়ির মূল ফটকের লোহার গেটের ফাঁকে, পরিত্যক্ত কমোডে, বিদ্যুতের তার আটকানোর সরঞ্জামাদিতে মশা ডিম পাড়ে।
ভি নাগপাল জানান, ১৯টি জায়গায় এডিস মশা বেশি পাওয়া গেছে। এগুলো হলো- পুরনো টায়ার, লন্ড্রি ট্যাংক, ঢাকনাবিহীন চৌবাচ্চা, ড্রাম বা ব্যারেল, অন্যান্য জলাধার, পোষা প্রাণীর পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের ব্লক, ফেলে রাখা বোতল ও টিনের ক্যান, গাছের ফোকর ও বাঁশ, দেয়ালে ঝুলে থাকা বোতল, পুরনো জুতা, ফুলের টব, পরিত্যক্ত খেলনা, ছাদে, অঙ্কুরোদগম উদ্ভিদ, বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্র, ইটের গর্ত ও অপরিচ্ছন্ন সুইমিং পুলে এডিস মশা জন্ম নেয়।
যেভাবে নিধন করতে হবে : বাড়ির ভেতর দরজা-জানালা বন্ধ করে মশার ওষুধ স্প্রে করতে হবে। খাট, চেয়ার-টেবিল ও বিছানার নিচে ওষুধ ছিটাতে হবে। যেখানে বেশি মানুষ থাকে, সেখানে এডিস মশা বেশি থাকে। সেখানে বেশি কামড়ায়। ড্রেনের মধ্যে ওষুধ ছিটালে মশা মরবে না। ওখানে মশা থাকে না।
ভি নাগপাল বলেছেন, যেখানে দিনের বেলায় লোক সমাগম বেশি থাকে যেমন অফিস-আদালত, হাটবাজার ও স্কুলে এডিস মশা বেশি কামড়ায়। যতক্ষণ পর্যন্ত পেট না ভরবে ততক্ষণ এটি কামড়াবে। একটা এডিস মশা সর্বোচ্চ ১৫ জনকে আর গড়ে পাঁচজনকে কামড়ায়। সব এডিস মশা এমনি ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে না। কিন্তু ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার কামড়ে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তিকে কোনো ভাইরাসমুক্ত এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমিত হবে।
ওই মশা যে ডিম পাড়বে তা ফুটে বাচ্চা বের হলে শতকরা ৬০ ভাগের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস থাকবে। অন্য মশার ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। কোনো ব্যক্তিকে কামড়ানোর পর সেই মশা আবার অন্য কাউকে কামড়ালে সেই ব্যক্তির ডেঙ্গু হতে পারে। এ কারণেই বর্তমান সময়ে বেশি লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, শুধু মশার ওষুধ ছিটালেই হবে না। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী মশার ওষুধ জায়গামতো ছিটাতে হবে। ভি নাগপাল বলেছেন, উড়ন্ত মশা মারতে হলে সূর্যোদের পরপরই এবং সূর্যাস্তের আগে ওষুধ ছিটাতে হবে। ফগিং মেশিনে ছিটানো ওষুধে শুধু উড়ন্ত মশা মরে, লার্ভা ধ্বংস হয় না।
ভি নাগপাল জানান, এডিস মশা খুব অল্প পানিতে (৫ মিলি বা ১ চা চামচ পানি) ডিম পাড়ে যা পানি ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। লার্ভা ধ্বংসে টেমিফস ১ গ্রাম/১০ লিটার পানিতে খুব কার্যকরী, যা ব্যবহার পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। নির্মাণাধীন ভবনের প্রজননস্থল ধ্বংস করে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব।
-কেএম