আদালতের রায় বাংলায় লিখতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

আদালতের রায় বাংলায় লিখতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
আদালতের রায় বাংলায় লিখতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

জাতীয়ঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ আদালতের রায় বাংলায় লেখার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে ট্রান্সলেটর নিয়োগ দানের ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিচার বিভাগের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

তিনি বিচারাধীন মামলাগুলোর দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণে বিচারক এবং আইনজীবীদের প্রতি আহবান জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘রায় যদি কেউ বাংলায় লিখতে না পারেন,ইংরেজীতে লেখেন কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সেই রায়টা বাংলায় ট্রান্সলেশন করে যেন প্রচার হয় সে ব্যবস্থাটা করে দিতে হবে।’

তিনি বলেন, আমাদের দেশে মামলার রায়গুলো ইংরেজীতে দেওয়া হয়। অনেকে সেই রায়টা বুঝতে না পারায় আইনজীবীরা যেভাবে বোঝান সেভাবে তাদের বুঝতে বা জানতে হয়।

তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন যাবত ইংরেজীতে লিখতে লিখতে অনেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাই বাংলাতেই রায় লিখতে হবে, এ ধরনের চাপ প্রয়োগ ঠিক নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমি বলবো এগুলো ট্রান্সলেশন করা এমন কোন কঠিন কাজ নয়, অনেক প্রফেশনাল ট্রান্সলেটর আছেন। তাদেরকেও আপনারা প্রশিক্ষণ দিয়ে নিতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে ঢাকা জেলার নবনির্মিত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ভবন উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর জনসন রোডস্থ আদালত পাড়ায় ঢাকা জেলার নবনির্মিত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ভবনের মুল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ট্রান্সলেটরদের কাজ হবে যেটাই লেখা হোক সব ট্রান্সলেশন হয়ে যাবে এবং সেটাই প্রচার হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ জানতে পারবে। ফলে বিচারের ফলে কি রায়টা হলো সে সেটা নিজে দেখে বুঝতে পারবে,জানতে পারবে।

তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতিকেও আমি অনুরোধ করবো, আইনমন্ত্রী ও এখানে আছেন, আপনারা কিছু ব্যবস্থা নেন। কারণ এটা জুডিশিয়াল ব্যাপার এর অনেক কথা, শব্দ, টার্মস যেগুলো আমাদের সাধারণক্ষেত্রে ব্যবহার হয়না সেগুলোর অনুবাদ যদি সহজভাবে করা যায়।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন,‘এ ব্যাপারে যদি কোন ফান্ড লাগে সেটারও ব্যবস্থা করবো। কিন্তু আমি চাই এটা যেন হয়।’
মানুষের ন্যায় বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যেকোন প্রকার সহযোগিতায় তাঁর সরকার সর্বদা প্রস্তুত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারাধীন মামলাগুলোর দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণেও বিচারক এবং আইনজীবীদের প্রতি আহবান জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘জুন ২০২০ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালতসমুহে ৩৭ লক্ষ ৯৪ হাজার ৯০৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুততম সময়ে রায় প্রদানের উপায় বের করার জন্য সকল বিচারক এবং আইনজীবীগণের কাছে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। ’

তিনি বলেন,‘ এই এত মামলা এভাবে জমে যেন না থাকে, কিভাবে এইসব মামলার বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যায় অবশ্যই এ ব্যাপারে একটু আন্তরিক হবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন।
‘এজন্য যে কোন ধরনের সহযোগিতা করতেও সরকার প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু এতগুলো মামলা এভাবে পড়ে থাকুক সেটা আমরা চাইনা,’যোগ করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে ভোগান্তি মুক্ত বিচার প্রাপ্তি মানুষের অধিকার। তাহলে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের যে আস্তা ও বিশ্বাস রয়েছে তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
আইন মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। আইন সচিব গোলাম সারোয়ার অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। । প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যেন ন্যায় বিচার পায়, বাংলাদেশের মানুষ যেন ভাল থাকে,স্বস্তিতে থাকে, শান্তিতে থাকে, নিরাপদে থাকে এবং উন্নত জীবন পায়। আর এখাবেই যেন আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারি, সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আইন সচিব গোলাম সারোয়ার মূল অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে ভবনের ফলক উন্মোচন করেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকা জেলার নবনির্মিত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ভবনের একটি রেপ্লিকাও উপহার দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং সকলেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ আবার ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে।’

কিন্তু তিনি এবং তাঁর বোন ( শেখ রেহনা) জাতির পিতার হত্যান্ডের বিচার চাইতে পারেননি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে জিয়াউর রহমান সে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আমরা এ জঘন্য হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছি।

তাঁর সরকারের সময়ে চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকান্ডের বিচার, নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত ৭ খুনের মামলা এবং হলি আর্টিজেন হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাসহ সকল চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার সম্পন্ন করা উল্লেখ করে এজন্য সংশ্লিষ্ট সকল বিচারকগণকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ লক্ষ্যে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য সমতার ভিত্তিতে সুবিচার নিশ্চিত করা এবং বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও এজলাস সংকট নিরসনের পাশাপাশি মামলা ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে অধঃস্তন আদালতে ১১২৬ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, দরিদ্র-অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের সরকারিভাবে আইনি সহায়তা প্রদান করার লক্ষ্যে দেশের ৬৪টি জেলা সদরে এবং সুপ্রীম কোর্টে লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করা হয়েছে, বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘২০০৯ থেকে জুলাই ২০২০ পর্যন্ত জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে সর্বমোট ৫ লক্ষ ২৫ হাজার ৩০ জনকে বিনামূল্যে আইনি সেবা প্রদান করা হয়েছে।’
বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই আন্তরিক উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকার ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর পরই ‘দি কোড অব ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর (সংশোধন) আইন,২০০৯’ পাশের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কাজটিকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।

অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল বাস্তবায়ন,বিচারকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জুডিশিয়াল ভাতা প্রদানসহ বিচার বিভাগের বিভিন্ন উন্নয়নের প্রসংগ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৪২টি জেলায় চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জন্য ৮-১০ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ২৯টি জেলায় নবনির্মিত আদালত ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এসব ভবনে স্থাপিত আদালতে এখন উন্নত পরিবেশে বিচারিক কাজ চলছে। অবশিষ্ট জেলাগুলোতেও চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, আজ ঢাকা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবনের উদ্বোধন করা হলো। আমার প্রত্যাশা, এ ভবন নির্মাণের মধ্য দিয়ে জনগণের বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে।

সন্ত্রাস বিরোধী মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ৭টি সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন, ৭টি বিভাগীয় শহরে সাইবার ট্রাইবুন্যাল স্থাপন,নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের পর ২০২০ সালে আরও ৬টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে, বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এ ছাড়া ৭টি মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করেন তিনি।

সরকার প্রধান আরো বলেন, ধর্ষণের মামলায় ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি প্রদানের জন্য মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে তাঁর সরকার ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০’ প্রণয়ন করেছে এবং মাদক সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করেছে।

তিনি বিচারপতি এবং আইনজীবীদের কল্যাণ কামনা করে তারা যেভাবে মানুষের পাশে রয়েছেন সেভাবেই তাদেরকে মানুষের পাশে থাকার ও আহবান জানান ।

তাঁর সরকার দারিদ্রের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সামাজিক খাতে নিরাপত্তা বিধান এবং দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচার প্রদান অব্যাহত রাখতে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্য ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার, আইন ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জের কারাগারে এ ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দাগী আসামীদের বিচারের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে দেশের সব কারাগারেই ভার্চুয়াল কোর্টের ব্যবস্থা রাখতে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে।

করোনাভাইরাসে সাবেক এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমসহ দেশ দিবেশে যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

যতদিন পর্যন্ত এর ভ্যাকসিন না আবিস্কার হবে বা সহজলভ্য হবে সে পর্যন্ত এর সুরক্ষা অত্যন্ত কঠিন আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং বাইরে বের হলে বা কর্মক্ষেত্রে গেলে মাস্ক ব্যবহারে তাঁর আহবান পুণর্ব্যক্ত করেন এবং বলেন, ‘এই করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে এবং অপরকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।’

-বাসস

FacebookTwitter