রোহিঙ্গা ‍ইস্যুঃ
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা।

কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন শিবিরে ঠাঁই হয়েছে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর। তবে সম্প্রতি এসব রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। হত্যা, মাদক ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গাদের কিছু অংশ। তাদের অপরাধ ঠেকাতে শিবিরের নিরাপত্তা আরো জোরদারে বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন করে দুই ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশ মোতায়েনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। একই সঙ্গে অপরাধপ্রবণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাম্পগুলোর চারপাশে তিন ফুট উচ্চতার কাঁটাতারের প্রাচীর নির্মাণ করারও প্রক্রিয়া চলছে বলে মন্ত্রণালয়ের সূত্রে প্রতিবেদনে জানানো হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, হত্যা-ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক, মানবপাচার, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা দিন দিন বেড়েছে। যে কারণে প্রাচীর নির্মাণ ও পুলিশ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাম্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে দুইটি আর্মড ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব আসার পরপরই প্রাথমিক পর্যায়ে ৫৮০ জনের এক আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে তা বাতিল করে ৮৮০ জনের টিম গঠন করে পাঠানোর উদ্যোগ চলছে।’

অপরদিকে, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের প্রস্তাবে ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাম্পের ভেতরে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের যৌথ ক্যাম্প স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য জরুরী ভিত্তিতে স্থান চিহ্নিত করে জমি বরাদ্দের উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।

শরণার্থী এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে পারে সরকার। তবে তা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়।’

বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেয়ার মতো সক্ষমতা সরকারের নেই উল্লেখ করে তিনি স্থায়ীভাবে কমিউনিটি পুলিশের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

অন্যদিকে, অপরাধ বন্ধ এবং ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে যাতে রোহিঙ্গারা অপরাধে না জড়াতে পারে সেজন্য কাঁটাতারের প্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৭টি আশ্রয় শিবিরের ১৫৭ কিলোমিটার জুড়ে এই প্রাচীর নির্মিত হবে। তিন ফুট উচ্চতার গাঁথুনির ওপর এ প্রাচীর নির্মাণের প্রক্রিয়া এরইমধ্যে শুরু করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে লক্ষ্যে দাপ্তরিক উদ্যোগ প্রায় শেষ করে এনেছে। মাঠপর্যায়ে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শিগগিরই শুরু করবে সেনাবাহিনী।

তবে এভাবে প্রাচীর দিয়ে রোহিঙ্গাদের আটকে রাখা যাবে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকারের ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠাতে পারলে স্থানীয় নিরাপত্তা যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি তার প্রভাব জাতীয় নিরাপত্তায়ও পড়বে।’

পাশাপাশি কক্সবাজার ও বান্দরবানের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তিন স্তরের নিরাপত্তা চেকপোস্টও কোনোভাবে আটকে রাখতে পারছে না তাদের। শরর্ণাথী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে ৫৮ হাজার ৩৫১ জন রোহিঙ্গাকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে ক্যাম্পে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য আটক হয়েছে ৫৩৬ জন দালাল।

এছাড়া নানা অপরাধে গত দুই বছরে ৪০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এসব ঘটনায় শতাধিক গ্রেপ্তার হলেও মামলা হয়েছে সাড়ে চারশো। সম্প্রতি টেকনাফের স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা হত্যার ঘটনায় গোটা ক্যাম্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা জোরদার করা হয়। ওই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ক্যাম্প পরিদর্শনে যান।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় ছয় হাজার একরের বেশি বনভূমি এলাকার ৩৪টি ক্যাম্পে দুই বছর ধরে বসবাস করছে প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথম কিস্তিতে ১২০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর কথা থাকলেও তা করতে পারেনি বাংলাদেশ। ওই বছরের এপ্রিলেই দুই দেশের মধ্যে সুরক্ষিত, স্বপ্রণোদিত প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতির পর ফের নতুন তারিখ দেয়া হয়, কিন্তু তাও বাস্তবায়ন করা যায়নি। সবশেষ গত ২২ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা থাকলেও এ উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেছে।

-কেএম

FacebookTwitter

About Bangla Daily

একটি পরিপূর্ণ বাংলা অনলাইন পত্রিকা। মাতৃভাষার দেশ বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সস্প্রচারিত হচ্ছে।

View all posts by Bangla Daily