অনলাইনঃ
১৯৭৮। জুলাই কিংবা আগস্ট মাস। রাজনীতির আকাশ টালমাটাল। ঈশান কোণে অনেক মেঘ। অন্ধকারে ছেয়ে আছে সমাজের ভেতর-বাহির। সংকট সর্বত্র। সেই সময়ে আড্ডা বসেছে সেগুনবাগিচার এক বাসায়। নানা কথায় চালশে পেরোনো এক যুবক বলে বসলেন, সমাধান একটাই।

অন্ধকার ঠেলে আলোর যাত্রা শুরু করতে হবে। একটা নতুন কিছু করতে হবে। এমন একটা কিছু যা তৈরি করবে মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ আর সংস্কৃতি চেতনাসম্পন্ন মানুষ। আর তা সম্ভব তারুণ্য দিয়েই। যারা দ্বিধাহীন চিত্তে পুরোনো আবর্জনা ঝেড়ে ফেলবে। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে একটা নতুন কিছু সৃষ্টি করবে। আড্ডায় সতীর্থদের প্রশ্ন, কিভাবে সম্ভব?

একটি আন্দোলন গড়তে হবে। আর তা হবে আলোকিত মানুষ তৈরির আন্দোলন। যা থেকে সঞ্চারিত হবে অনুপ্রেরণা, সাহায্য, সহযোগিতা। এই কেন্দ্রে থাকবে বিশ্বসাহিত্যের যাবতীয় উপকরণ। কেন্দ্রে গড়ে উঠবে বিভিন্ন শাখার ওপর পাঠচক্র। যা প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

আবারও সেই যুবককে প্রশ্নবিদ্ধ জিজ্ঞাসা, এ কাজের জন্য অর্থ আসবে কোত্থেকে? এটা নিছক ইউটোপিয়ান স্বপ্নবিলাস। উপস্থিত অনেকের মন্তব্য ছিল এমনই। কিন্তু দমলেন না সেই যুবক। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। বললেন, মানুষের মধ্যেও মানুষ থাকে। তাদের খুঁজে বের করতে হবে। সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে। চ্যালেঞ্জ করা সেই মানুষটি বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করেন। একদিন সেই বীজ থেকে জন্ম নেয়া চারা। সগৌরবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

সেই স্বপ্নদ্রষ্টা আর কেউ নন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। যিনি এক পলকের জন্যও তার চ্যালেঞ্জের কথা ভুলেননি। অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন আজকের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আলোকিত মানুষ গড়ায় নিরত লড়াই চলছে যেখানে। চারদশক আগে অনেকের কাছে এটি ইউটোপিয়ান চিন্তা হলেও আজ আর তা বিক্ষিপ্ত কোনো স্বপ্ন নয়, কোনো বিচ্ছিন্ন ভাবালুতা নয়। লাল ইটের পরতে পরতে আজ সেখানে ছড়িয়ে আছে সাফল্য আর সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি।


আহমদ ছফাকে চেনেন না এমন মানুষ কমই আছেন। স্পষ্ট কথা আর স্পষ্ট জীবন বোধের জন্য আলোচিত একটি নাম। বাংলামটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলিতেই থাকতেন তিনি। বোধকরি বাড়িটির নম্বর ১২/এ। আড়াই তলা শ্যাওলা পড়া এই বাড়িটিতে একদিন আহমদ ছফার সাক্ষাৎ মেলে। শীতের সকালে রোদ পোহাচ্ছিলেন। লাল চা আর টোস্ট বিস্কুটের কুড়মুড়ে শব্দে তিনি জানতে চাইলেন কি করা হয়? পাঠচক্রে বই পড়ি বলতেই একটু থেমে বললেন, ‘ও-তুমি লালুর মুড়ির দোকানে যাও।

পরে জেনেছিলাম, সায়ীদ স্যারের ডাক নাম লালু। তাই অনেকেই তাকে লালুভাই বলে ডাকতেন। আর ছাদের ছোলা মুড়ির দোকানটি বাংলামটর এলাকায় পরিচিত হয়ে গিয়েছিল লালুভাইয়ের মুড়ির দোকান বলে। আহমদ ছফা সেদিন উইট আর হিউমার মিশিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে মুড়ির দোকান বললেও বাস্তবতা হচ্ছে আশপাশের অনেকেরই কেন্দ্রের কর্মসূচি সম্পর্কে বহুদিন পর্যন্ত স্পষ্ট ধারণা ছিল না। প্রশ্ন ছিল কি হয় এখানে? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘আমার অনুভূতিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বই থেকে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ঘটনা। মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে বৈঠকে বসেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নানা আলোচনার ফাঁকে তিনি বলে ওঠেন, ‘বাংলাদেশে যে নাস্তিকদের বড়সড় হেডকোয়ার্টার রয়েছে খবর রাখেন আপনারা?’ মন্ত্রীরা সবাই এ ওর দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলেন। সবাই এ ধরনেরই কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তাহলে জানেন না আপনারা?

সবার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বিরক্তি ও হতাশার সঙ্গে সবাইকে এরশাদ দেখে নিলেন একবার। তারপর সবাইকে খানিকটা হতচকিত করে বললেন, ওই হেড কোয়ার্টার হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

এমন নানা বিভ্রান্তি আর সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কাজ করে গেছেন নিরলস। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নিজস্ব কোনো মতাদর্শ নেই। কেন্দ্র কাউকে কোনো মতাদর্শে দীক্ষিত করে না। কেন্দ্রের যদি কোনো মতাদর্শ থাকে তবে তা- মনুষ্যত্বের সমৃদ্ধি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চারদশক ধরে এই আদর্শের জন্য লড়াই করছে।

এক ইউটোপিয়ান স্বপ্নবিলাস থেকেই যে প্রতিষ্ঠানের সূচনা তা আজ বিশ্বজুড়ে প্রচলিত ধারার শিক্ষার বিপরীতে সৃজনশীল মননের বিকাশে অনন্য ধারা যুক্ত করেছে। ফিরে তাকালে অবাক হতে হয় কিভাবে এই সাফল্যের যোজনা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন ঢাকা কলেজের জনপ্রিয় শিক্ষক। বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্ররা মুখিয়ে থাকতেন সায়ীদ স্যারের বক্তৃতা শোনার জন্য। সে ক্লাসের কোনো সময় আর সীমানা ছিল না। চার দেয়ালে আবদ্ধ নয় সে ক্লাস। কবে ক্লাস নেবেন সায়ীদ স্যার এটি ছিল আলোচনার বিষয়। সেই দীপ্তিমান আলোক ছড়ানো কথাগুলো পরে স্যার বিলিয়ে দেন কেন্দ্রের মাধ্যমে শহর, গ্রাম, জেলা, উপজেলা সবখানে।

এক সময় যে কর্মসূচি সীমাবদ্ধ ছিল পাঠকক্ষে আজ তা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকাতে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সূচনা ১৯৭৮ সালের ১৭ই ডিসেম্বরে ঢাকা কলেজের পাশে নায়েম সেন্টারে। বন্ধুদের আড্ডায় দেয়া চ্যালেঞ্জ শত ব্যস্ততা আর বাস্তবতায়ও ভুলেননি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সম্পাদনা, শিক্ষকতার বেড়া ডিঙিয়ে তিনি স্বপ্ন বুনেছেন সংগঠক হওয়ার। সেগুনবাগিচার আড্ডার মাস চারেক পরই সতীর্থদের একদিন ডাকলেন ঢাকা কলেজের পাশে নায়েম সেন্টারে। চালু করলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রথম অনুশীলন। প্রথম অনুদান দিয়েছিলেন রেডিওর সাবেক মহাপরিচালক আশরাফউজ্জামান খান।

পঁয়ত্রিশ টাকা। যা দিয়েই শুরু হয়েছিল আলোকিত মানুষ গড়ার কঠিন সংগ্রাম। আর কঠিন সেই সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

নায়েম সেন্টার থেকে ১৯৮৩ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চলে যায় ইন্দিরা রোডের ভাড়া বাড়িতে। সেখান থেকে একই বছর ১৪ ময়মনসিংহ রোডে। পঁয়ত্রিশ টাকায় যাত্রা শুরু হওয়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে আর সেখান থেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চারদশকে এর কর্মসূচি ছড়িয়েছে দেশজুড়ে নানা প্রকারে। দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম, দেশভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি, আলোর ইশকুল, দেশভিত্তিক পাঠচক্র, অনলাইনে বইপড়া কার্যক্রম আলোর পাঠশালা, কি নেই?

আড়াই তলা ছোট ভবন থেকে বর্তমানে দশ তলা ভবনে স্থায়ীরূপ পেয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বর্তমানে এর বিভিন্ন কার্যক্রমে ২৭ লাখ সভ্য নানামুখী কার্যক্রমে অংশ নিয়ে প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ হচ্ছে।


নিজের ব্যক্তিগত জীবন বদলের গল্প বললে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। আমি তখন নটর ডেমে। সময়টা ১৯৯৩ সাল।রেসেস পিরিয়ড চলছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী গল্পের নায়কদের তখন বিরতি। দুই টাকার সমুচা আর চার টাকার পেটিস ততক্ষণে জিভে জল এনেছে। বারান্দায় গিজগিজ। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলছি ভিড় এড়িয়ে। বাইরে ফাগুন হাওয়া। কোলাহলের হল্লায় চোখে পড়লো একটি হাত। হলুদ লিফলেটের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দিন বলতেই, হাতে আসে সেই উড়ন্ত হলুদ বার্তা। তাকিয়ে দেখি কালো হরফে লেখা, বই পড়লেই পুরস্কার। তাও আবার হাজার টাকার বই।

সহপাঠীদের সঙ্গে পরামর্শ করি, চল না যাই। দল বেঁধে ছুটে যাই চোরাগলির লাল ইটের সেই বাড়িটিতে। গলিপথ পেরিয়ে উঁকি দিতেই মন আটকে যায়। সবুজ দূর্বাঘাসে ছাওয়া লনের পাশে নাগলিঙ্গম, মহুয়া, রঙ্গন, শিউলি, কামিনী।

নানান সুভাসে মউ মউ করছে চারদিক। মন বলছে, ওদের বন্ধুতা আমার চাই-ই চাই। হলুদ লিফলেটের সেই নেশায় বুঁদ হয়ে গেলাম সে থেকেই। এভাবেই চিরায়ত, আদর্শিক জীবন বদলে যাওয়া চরিত্রগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয়। সক্রেটিস, প্লেটো, টলস্টয়, মার্কটোয়েন, ম্যাক্সিম গোর্কি, এডগার এলান পো, নিকোলাই গোগল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কত বুদ্ধিদীপ্ত লেখকের সঙ্গে পরিচয়। তাঁদের লেখায় চরিত্রগুলো নিয়ে দিনভর মশগুল থাকি। আর সেইসব দিনগুলোতে যে মানুষটি বইয়ের পেছনের মানুষদের গল্প বলতেন, আদর্শিক অবস্থান তুলে ধরতেন সেই আলোর ইশকুলের কারিগর ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

প্রথমদিনের স্মৃতিতে মনে পড়ে, লাল ইটের দেয়াল পেরিয়ে ধাক্কা লাগে এক কক্ষের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে। নাম ছিল সুরঞ্জনা। সেখানেই জমা দিতে হবে হলুদ লিফলেটের শর্ত অনুযায়ী দশ টাকার অফেরতযোগ্য ফি, চল্লিশ টাকার নিরাপত্তা জামানত। সেই শুরু যার শেষ নেই। সেই দশ টাকায় বই পড়েছি কত শত তার ইয়ত্তা নেই। বলা চলে বইয়ের রাজ্যে সেই থেকেই ঢুকে পড়া। আজও মাতাল হয়ে আছি বইয়ের নেশায়।

সপ্তাহ শেষে ছুটির সকাল-বিকাল সায়ীদ স্যারের তীক্ষ্ণ শক্তি দিয়ে চরিত্রগুলোর বিশ্লেষণ আমাদের ভাবিয়ে রাখত দিনকে দিন। পাঠ আলোচনা শেষে ছোলা-মুড়ি আর লাল চায়ে চলত নানা দার্শনিক তথ্য আর তত্ত্বের বৈঠকি আসর। চলমান কেরানি বৃত্তান্তের বাইরে জীবনকে ভাবা সেই থেকেই শুরু। কুয়োর ব্যাঙ আর সাগরের তিমির মধ্যে তফাতটা কোথায় তা-ও বুঝেছিলাম সক্রেটিয়ান এই স্কুল থেকেই। শুরুতে মাত্র ২৫ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে একটি পাঠচক্র শুরু হয়েছিল। গত চার দশকে এমন অগুণতি পাঠচক্রে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আজ আলো ছড়াচ্ছে ছয়টি মহাদেশে। অনুসন্ধিৎসু এমন পথ পরিক্রমায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লড়ে চলেছে।


বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লক্ষ্য কি? বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কি করতে চায়? এমন প্রশ্নে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর সাফ জবাব, আমাদের লক্ষ্য, ‘আরো একটু ভালো।’ দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি বলেন, কেউ যদি জীবনে পুলিশের একজন দারোগাও হয় তাহলে সে যেন আরো একটু ভালো দারোগা হয়। প্রগতি বা প্রতিক্রিয়া এই দুদলের কারো ব্যাপারেই দায় নেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের। বিশ্বসাহিত্য মানুষের গুণগত সমৃদ্ধির লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

-সংগৃহীত

FacebookTwitter

About Bangla Daily

একটি পরিপূর্ণ বাংলা অনলাইন পত্রিকা। মাতৃভাষার দেশ বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সস্প্রচারিত হচ্ছে।

View all posts by Bangla Daily