বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি প্রত্যাখ্যান দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা বদলে দিয়েছে

বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি প্রত্যাখ্যান দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা বদলে দিয়েছে
বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি প্রত্যাখ্যান দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা বদলে দিয়েছে

জাতীয়ঃ
তাঁর মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতির যে কোনও কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বলেছেন, তাঁর (বঙ্গমাতার) বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা বদলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমার মায়ের অবদান সম্পর্কে সবচেয়ে আকাঙ্খিত বিষয়টি হল আমার মা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে, আমি দুঃখের সাথে বলছি, অনেক বড় নেতাই তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’

বঙ্গমাতার ৯০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে গোলটেবিল আলোচনায় যোগ দেয়ার জন্য প্যারোলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হলে জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি (বঙ্গমাতা) সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই সঠিক ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত আইয়ুব খানকে (আগরতলা ষড়যন্ত্র) মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পথও বদলে দিয়েছিল।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘তিনি (বঙ্গমাতা) দলকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করতেন (বিশেষত বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন) এবং সঠিক সিদ্ধান্ত দিতেন।’

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে গণভবন থেকে যোগদান করেন।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং গোপালগঞ্জ থেকে অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা সংযুক্ত হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বঙ্গমাতাকেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। যে কারণে তাঁকে (বঙ্গমাতাকে) বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।’

তিনি বলেন, ‘বঙ্গমাতা জানতেন এবং তাঁর বড় মেয়ে হিসেবে আমিও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তিনি কখনও মনোবল হারাননি।’

তিনি আরো বলেন, জাতির পিতাকে প্যারোলে মুক্তি দিলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বাকী আসামীদের কি হবে সেটা সব সময়ই বঙ্গমাতার চিন্তায় ছিল, কেননা ৩৫ জন আসামীর মধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হককে কারাগারেই হত্যা করেছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তা।

এ সময় জাতির ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদানের সময়ও বঙ্গবমাতা যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তার উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘এটি কোন লিখিত ভাষণ ছিল না বা এজন্য বঙ্গবন্ধু কোন রিহার্সেলও করেননি।’

ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে একটি কক্ষে খানিকটা বিশ্রামের সুযোগ করে দিয়ে বঙ্গমাতা তাঁকে একান্তে যে কথা বলেন, সে সময়ে সে কক্ষে উপস্থিত পরিবারের অপর সদস্য শেখ হাসিনা সে কথাও ভাষণে তুলে করেন।

বঙ্গমাতা বলেছিলেন,‘তুমি বাংলার মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছ কাজেই তুমি জান কি বলতে হবে। তোমার মনে যা আসে তাই বলবে, কারো কথা শোনার দরকার নেই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ জাতির পিতার ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কো কতৃর্ক বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে তাঁর স্থান করে নিয়েছে।’

আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বঙ্গমাতার অবদান স্মরণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে বঙ্গমাতার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল যেখানে সে সময়কার অনেক বড় বড় নেতারাও বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন।’

শিশু একাডেমি প্রান্ত থেকে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে একশ’ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ল্যাপটপ, দরিদ্র, অসহায় নারীদের মধ্যে ৩২শ’ সেলাই মেশিন এবং ১৩শ দরিদ্র নারীকে ‘নগদ’ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তন প্রান্ত থেকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তারও বক্তৃতা করেন।

গণভবন প্রান্তে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। এছাড়া অনুষ্ঠানে সংযুক্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি ভিডিও চিত্রও প্রদর্শিত হয়।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জাতির পিতার সহধর্মিনী এবং শেখ হাসিনার মা’ বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারের নিহত তিনি।

বঙ্গমাতার সংগ্রাম ও ত্যাগের কিছু খন্ড চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ত্যাগের মধ্যে দিয়ে একটা সংসারকে সুন্দর করা যায়, একটা প্রতিষ্ঠানকে সুন্দর করা যায়, একটা দেশকে সুন্দর করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘আব্বার যে আর্দশ, সেই আর্দশটা তিনি খুব সঠিক ভাবে তিনি ধারণ করেছিলেন। আর সেটা ধারন করেই তিনি নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন।’
‘চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। আমার মা সেই দৃষ্টান্তই দেখিয়ে গেছেন,’ যোগ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর এবং বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সহযোদ্ধা। বঙ্গমাতা অসাধারণ বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, সর্বসংহা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন এবং আমৃত্যু দেশ ও জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, আজকে বঙ্গমাতার জন্মদিন। সেই জন্মের পর ৩ বছর থেকেই পিতা মাতা সব হারিয়ে সারাটা জীবন শুধু সংগ্রামই করে গেছেন। কষ্টই করে গেছেন। কিন্তু এই দেশের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতার জন্য তিনি যে কত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন সেটা আমরা জানি।

সংসার সামলে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার সহধর্মিনী সহযোগিতা করতেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’প্রতিটি কাজে আমার মাকেও দেখেছি বাবার পাশে থেকে থেকে সহযোগিতা করেছেন। কখনো সংসারের কোন সমস্যা নিয়ে বিরক্ত করেননি বা বলেনও নি।’

তিনি বলেন, বেশির ভাগ সময়ই তো আমার বাবা কারাগারে ছিলেন। একটানা দুই বছরও তিনি কারাগারের বাইরে থাকেন নি। কিন্তু আমার মা যখন কারাগারে দেখা করতে যেতেন তখন মা নিজেই বলতেন, ‘চিন্তার কিছু নেই।’ সব কিছু তিনি নিজেই দেখতেন ।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব আমার মায়ের হাতেই ছিল। তার পাশাপাশি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ প্রতিটি সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। নির্দেশনা দেওয়া বা বাইরের অবস্থা জেলখানায় থাকা আব্বাকে জানানো, বাবার নির্দেশনা নিয়ে এসে সেগুলো পৌঁছে দেওয়া। এই কাজগুলো তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে করতেন।’
বঙ্গমাতার মধ্যে কোন অহমিকা বোধ ছিল না, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাবা যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফিরে এলেন তখনও কিন্তু আমার মায়ের মধ্যে এই অহমিকা বোধ কখনো ছিল না এবং তিনি কখনো সরকারি বাস ভবনে বসবাস করেননি। ’

‘কাজের জন্য আমার বাবা সকালে চলে আসতেন, বাড়ি থেকে নাস্তা করে চলে আসতেন। আবার দুপুরে আমার মা নিজের হাতে রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার পাঠিয়ে দিতেন। রান্নাটা সব সময় নিজের হাতে করতেন। তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী পাকের ঘরে গিয়ে রান্না করবেন সেই সমস্ত চিন্তা তার কখনো ছিল না, ’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।

নিজের মায়ের হাতের রান্না সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের হাতের রান্না খুবই সুস্বাধু ছিল।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা শিক্ষা পেয়েছি বাবা-মায়ের কাছ থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে চলার। অন্তত তোমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় কে আছে তাকে দেখো। উপরের দিকে না, তোমার চেয়ে কে ভালো আছে সেটা তোমার চেয়ে খারাপ যারা আছে তাদের দিকে দেখো এবং সেটাই উপলব্ধি করো। কখনো নিজের দৈন্যতার কথা বলতেন না। কখনো কোন চাহিদা ছিল না। নিজে কোন দিন কিছু চাননি। সব সময় তিনি দিয়ে গেছেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন তাঁর মা’ গণভবনে বা সরকারি বাস ভবনে না থাকার কারণ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি বলতেন (বঙ্গমাতা) আমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে সরকারি বাস ভবন বা শানশওকতে থাকবো না। তারা বিলাসী জীবনে অভ্যস্থ হোক সেটা আমি চাই না।’

প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ‘বিলাসিতায় আমরা যেন গা না ভাসাই সেটার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি সব সময় আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।’
বঙ্গমাতার দৃঢ়চেতা মনভাবের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ’৭৫ এর বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করেন।

তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট বেগম ফজিলতুন নেছা মুজিব খুনিদের কাছে জীবন ভিক্ষা চাননি। নিজেও বাঁচতে চাননি। তিনি সাহসের সঙ্গে একথাই বলেছেন-আমার স্বামীকে হত্যা করেছো, আমি তাঁর কাছেই যাব’।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। কাজেই জীবনে-মরণে তিনি আমার বাবার একজন উপযুক্ত সাথী হিসেবেই চলে গেছেন।’

-বাসস

FacebookTwitter