মিরি সুলতানা, কুইন্স, নিউইয়র্ক থেকেঃ
সময়টা ছিলো আশির দশক। বিটিভির এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। লেখকের পাশে ঝলমলে এক তরুণীকে বসে থাকতে দেখা গেলো। তরুণীর পরনে গোলাপী সিল্কের শাড়ি কানে পাথরের দুল নাকে ডায়মন্ডের নাকফুল। বামহাতে কালো বেল্টের ঘড়ি ডানহাতে একসেট চমৎকার চুড়ি। ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক চোখে কাজলের আঁচড়।
কি অপূর্ব বসার ভঙ্গি! চেহারার অভিব্যক্তিতে ছিলো আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। সেদিন উপস্থাপক তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদের সহধর্মিণী হিসেবে। তবে গুলতেকিনকে হুমায়ূন আহমেদের পাশাপাশি না বসিয়ে বসানো হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদের ঠিক বিপরীত দিকে। অর্থাৎ দুজনের পিঠ দুজনের দিকে। কেউ কারো মুখ দেখছেন না। লেখক তাঁর স্ত্রীর প্রতি কতটা মনোযোগী তার একটা ছোটখাটো পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। যেমন লেখককে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, গুলতেকিন কোন কালারের শাড়ি পরেছেন? কানে কি ধরণের দুল পরেছেন? ঘড়ি পরেছেন কি? কাঁচের চুড়ি পরে আছেন নাকি সোনার চুড়ি পরে আছেন? এসব প্রশ্নের একটারও সঠিক উত্তর হুমায়ূন আহমেদ দিতে পারেননি। সেদিন হাসির ছলে গুলতেকিন বলেছেন, “ও’ কখনোই ঠিকঠাক কিছু বলতে পারেনা। সারাক্ষণ উদাসী………!!” সেই ছোটবেলা থেকেই গুলতেকিনকে আমার হৃদয়ে ধরে যায়। এত সুন্দর বাচ্চাবাচ্চা চেহারা আর খুব মেপে মেপে কথা বলা। এরপর গুলতেকিনের জীবনে ঘটে যাওয়া ইতিহাস কার না জানা আছে?
হুমায়ূন আহমেদের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তাঁকে সীমাহীন যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ সইতে হয়েছে। চুপচাপ সয়ে গেছেন। নিজের বুকের রক্তক্ষরণ সযত্নে লুকিয়ে রেখে ছেলেমেয়েদেরকে বুকে আগলে রেখেছেন।বুকে দমিয়ে রাখা আর্তনাদ তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। কিন্তু কোন অভিযোগ করেননি। তিনি কখনো প্রচারের কাঙাল ছিলেন না। এমনকি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতেও তিনি স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন না। এই পরিচয়টা পছন্দ ছিলো না গুলতেকিনের। তিনি তাঁর আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে চলেছেন।
আজ কেউ কেউ যখন গাধার মত বলে, “গুলতেকিন খান বিয়ে করে নিজের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী হিসেবে তিনি যে সম্মানটুকু পেতেন, তা হারিয়ে ফেলেছেন।” —উর্বর মস্তিষ্কের লোকদের এসব কথা শুনে হাসি কান্না কোনটাই আসেনা আমার। আপনারা কিসের উপর ভিত্তি করে গুলতেকিনের সমালোচনা করছেন? যখন নুহাশ আহমেদ তার বাবার স্নেহ মমতা পাবার জন্য পাগল হয়ে ধানমন্ডির দখিন হাওয়ায় ছুটে যেতো, দেখতো তার বাবা আস্তে আস্তে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছেন। শোকেসে যেখানে নুহাশের খেলনা থাকতো বেবি পাউডার বেবি লোশন থাকতো, সেখানে রিমোট কন্ট্রোল খেলনা ও অন্য সরঞ্জামে ভর্তি। নিজের খেলনা রাখার জায়গা জবরদখল হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি বালক নুহাশ। চোখের জল মুছতে মুছতে অপরিচিত দখিন হাওয়া থেকে বের হয়ে আসতো। নুহাশের তখন পরিণত বয়স ছিলো না। তার প্রিয় বাবার আদর ভাগ হয়ে গেছে —এই কষ্টটা একবার নিজের সন্তানকে কল্পনা করে ভাবুন তো!!!! ভেবে যদি আপনার কষ্ট হয়, তাহলে আপনি মানুষ। আর যদি কষ্ট না হয় তাহলে আপনি সন্দেহাতীতভাবেই অমানুষ।
গুলতেকিন বিয়ে করেছেন, তিনি খুব সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের সমাজে দুই ধরণের লোক আছে। পজিটিভ পাওয়ার এবং নেগেটিভ পাওয়ারের লোক। নেগেটিভ পাওয়ারের মানুষ গুলতেকিনের বিয়ে নিয়ে টীকা টিপ্পনী কাটছে। তাঁর বয়স হিসেব করার জন্য অঙ্কের কোর্স করছে। হাস্যকর বটে। গুলতেকিন খান দীর্ঘবছর যত অপমান অবজ্ঞা চুপচাপ সয়েছেন, আপনি আমি সেটা দশদিনও সহ্য করতাম না। গুলতেকিন খান প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর নাতনি। আজীবন তিনি দাদার Ideology নিয়ে চলেছেন। হুমায়ূন আহমেদের পরিচয়ে তিনি কমফোর্ট ছিলেন না। বরং নোভা বিপাশা শীলা নুহাশ আহমেদের মা হিসেবে তিনি অধিক স্বতঃস্ফূর্ত। গুলতেকিন খান আফতাব আহমেদের সুখী দাম্পত্য জীবন কামনা করছি। এইটুকু সুখ তিনি ডিজার্ভ করেন।
-শিশিন